সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী'




দেবী (১৯৬০) 

আমরা এক অদ্ভুত সময় পার করছি। কালান্তক রোগে লাখো মানুষের জীবন সংশয় এর মোকাবিলায় ব্যস্ত পুরো পৃথিবী সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি চিরায়ত ধর্মাচার পালনে শশব্যস্ত জনগোষ্ঠীর আত্মঘাতী  আচার পালনের উল্লম্ফন।  

ধর্ম জীবনের ঊর্ধ্বে নয়। ধর্ম পালন এবং সেই ধর্ম  পালনের নামে অন্ধ বিশ্বাস লালন দুটো সম্পূর্ণই আলাদা  প্রেক্ষাপটের জন্ম দেয়।

যেমনটি আমরা দেখতে পাই দেবী চলচ্চিত্রে। সত্যজিৎ রায় ছবিটি নির্মাণ  করেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এর একটি গল্পের অবলম্বনে।

সত্যজিৎ তার চলচ্চিত্র নির্মাণের  অনন্য ধাঁচের প্রয়োগে  গল্প থেকে সিনেমার  নির্মাণ  করেছেন, শটের ব্যবহার,  চরিত্র সমূহের সাযুজ্য  রক্ষা, সকল ক্ষেত্রেই তার  মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে।

কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে বর্তমানে যে বিষয়টি একজন সচেতন দর্শকের মনে দাগ কাটবে তা হলো চলচ্চিত্রের প্লট। 


জমিদার কালীকিঙ্করের দুই ছেলে, ছেলের বউ এবং একমাত্র নাতিকে নিয়ে সাজানো সংসার। সংসারের  আদর্শ বউ এর ভূমিকায়  অবতীর্ণ  তার ছোট ছেলে উমাপ্রসাদের স্ত্রী  দয়াময়ী।  দয়াময়ী একজন আদর্শ ছেলের বউ,  স্ত্রী,  জা এবং কাকিমা। সব সুচারুভাবে চলছিলো কিন্তু গল্পের মোড় ঘুরে যায় কালীকিঙ্করের স্বপ্ন দেখার ফলে৷ স্বপ্নে তিনি দয়াকে দেবীরূপে দেখতে পান। তারপর থেকে দয়াময়ীর জীবনে আসে আমূল পরিবর্তন। পুরোহিত তার সম্মুখে জপ করতে থাকে কালীমন্ত্র, পায়ে গড় প্রণাম করতে থাকে শ্বশুর সহ আপামর সাধারণ,  সকলের কাছে মহাদেবীর  আখ্যা লাভ করে তিলে তিলে সতেরো বছর বয়সী দয়াময়ী যেন  সম্পূর্ণ অন্য ভুবনের কেউ হয়ে উঠে।  আচমকা এক ছেলের জীবন বাঁচে তার আশ্রয়ে এসে।  তারপর দয়াময়ী নিজেই দ্বিধান্বিত নিজেকে নিয়ে, আসলেই কি তার মাঝে তবে দেবী বিরাজিতা, সত্যিই কি  অলৌকিক ক্ষমতার আস্ফালনে সে বাঁচিয়ে তুলেছে একটি জীবন?
গল্পের করুণ পরিণতি নামে খোকার মৃত্যু তে। সেই খোকা যে দয়াময়ী কে মায়ের চাইতেও বেশি ভালোবাসতো বলে অভিযোগ ছিলো তার মায়ের, সেই খোকা যার মুখে নাড়ু পুরে দিয়ে হাসিতে ভরে যেতো দয়ার ভুবন, সেই খোকা যে দয়ার গল্প না শোনে ঘুমাতো না।  দয়ার অলৌকিক ক্ষমতার ভরসায় কোন ওষুধ না দিয়ে তাকে দয়ার কোলে তুলে দেওয়া হলো। খোকার মৃত্যুতে দয়ার দেবীত্ব নাশ হলো।  কিন্তু কেবল দেবীত্বই কি ভুল প্রমাণ হলো? নাকি একটি মৃত্যু আরো অদেখা মৃত্যু গুলিকে চোখের সামনে নিয়ে আসলো?



দয়াময়ী আর তার স্বামী উমাপ্রসাদের প্রেমময় সম্পর্কের মৃত্যু হচ্ছিলো তিলে তিলে। পড়া লেখা জানা উমাপ্রসাদ মানবী দয়াকেই চাইতো। দেবী দয়াময়ী তার কাম্য ছিলো না।উমাপ্রসাদ বারবার তার বাবার অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের কথা তুললেও শেষ রক্ষা করতে পারে না। দয়াময়ী  আর  কখনোই পূর্বেকার  দয়াময়ী হয়ে তার জীবনে আসে নি।  চিঠি লিখতো যে দয়া,  নানান প্রশ্নে জর্জরিত করতো যে দয়া, তার সাথে যেকোন স্থানে যেতে নিঃসংকোচ যে দয়া, চিরতরে হারিয়ে যায় সে।

মৃত্যু হয় গৃহিণী দয়াময়ীর। যে বাড়ির পোষ্য পাখিটিও যাকে  খাদ্যের প্রয়োজনের কথা জানায় যেমন সন্তান জানায় তার মাকে। বৃদ্ধ শ্বশুর যার সেবায় মুগ্ধ। বড় জায়ের কাছে যে ছোট বোনের মতোন।

মৃত্যু হয় মাতৃসুলভা দয়াময়ীর।  খোকা নিজের মাকে লুকিয়ে যার কাছে ঘুমোতে যেতো।

এ সমস্ত  কিছুর মূলে রয়েছে একজন বৃদ্ধের অন্ধবিশ্বাস।  যিনি তার ছেলের বৌকে মাতৃজ্ঞানে আরাধনা করার প্রয়াস করেন।  মানবীর মাঝে যিনি দেবীর কাল্পনিক অতিমানবিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার বৃথা চেষ্টায় মত্ত ছিলেন।  একজনের অন্ধবিশ্বাস আরো সহস্র জনে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের সরল লোকের মাঝে তার বিশ্বাস এর ছোঁয়াচ লাগলো। কাছে দূরের সকল গ্রামের ছেলে বুড়ো মিলে ছুটলো  অদেখা দেবীর কৃপালাভের আশায়।

বিশ্বাসের মতোন শক্তিশালী অস্ত্র আর কিছু নেই। আর তা যদি হয় ধর্মবিশ্বাস তবে কোন কিছর পরোয়া না করে  অনেক সময় নিশ্চিত মৃত্যু জেনে মানুষ ছুটে চলে দূর থেকে দূরে।  তার প্রমাণ আমরা আজও পেয়ে চলেছি।

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত আর সকল ছবির মতোনই দেবী একই সাথে উপভোগ্য এবং সামাজিক অবকাঠামোর সমালোচনায় অতিশয়  সুচারু।

©  Poroma Shome

1 comment:

  1. অনবদ্য লেখনী। ষাটের দশকের একটি চলচ্চিত্রের বক্তব্য এখনের সময়ে এসেও কতটা শক্তিশালী, কতটা জোড়ালো, কতটা তীব্র আর সময়ানুগ, লেখনী যেন তারই সাবলীল বহিঃপ্রকাশ।

    ReplyDelete

Powered by Blogger.