ঋতুপর্ণ ঘোষের ঊনিশে এপ্রিল
![]() |
| ঊনিশে এপ্রিল (১৯৯৪) |
অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি, স্বীকৃতি, মেধা এ সমস্ত বিষয়াবলিকে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকে। সকল বস্তুগত প্রাপ্তি - অপ্রাপ্তির হিসেব রাখতে গিয়ে জীবনে সম্পর্কে সমূহের গুরুত্ব এবং সেগুলো ধরে রাখায় আসলে কি প্রয়োজন তা খুব কমই ভাবে।
এক্ষেত্রে আমাদের ভাবনার দোয়ারে নতুন কিছু উপাদান নিয়ে টোকা মারেন প্রয়াত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। তার পরিচালিত ঊনিশে এপ্রিল আমাদের মানব জীবনের কিছু চিরায়ত সম্পর্ক নিয়ে ভাবায়। বাবা ভরণপোষণের দায় নিবেন, মা মেধা মনন শাণিত করায় ভূমিকা রাখবেন, সন্তানের লাভে দুয়ে বাৎসল্যরসের নতুন আধার পাবেন৷ সময়ে সেই সন্তান বড় হয়ে উঠবে। তার নিজের জীবন সাজাবে যেখানে সেই মা - বাবার যথাযোগ্য স্থান থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। আমরা এমনটা ধরে নিয়ে সন্তানের সাথেও যে মা - বাবার সম্পর্কের রসায়নে বিস্তর টানাপোড়নের বৈচিত্র থাকতে পারে তা খুব কম মাথায় আনি।
এ চলচ্চিত্রে মায়ের সাথে মেয়ের সম্পর্কের খাদ সমূহ গল্প বলার মূল উপাদান। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী সরোজিনী গুপ্তের একমাত্র মেয়ে অদিতি ( মিঠু)। ডাক্তারি পাশ করে কিছুদিনের জন্যে বাড়ি এসেছে। তার বাড়ি থাকাকালীন সময়কার একটা বিশেষ দিনের গল্প বলা হচ্ছে। সেদিন ঊনিশে এপ্রিল। অদিতির বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। আবার একই দিন তার মা ভূষিত হলেন একটি পুরষ্কারে। অদিতি মায়ের প্রাপ্তির আনন্দের অংশীদার হয় নি। বাবার স্মৃতির উদযাপন তার কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু মায়ের সাথে মেয়ের এহেন দুরত্ব কেন? অদিতি তার মায়ের এমন খ্যাতিতে মুগ্ধ নয় কেন? অদিতির বন্ধুর কাছে কেন সে মায়ের প্রসঙ্গে কথাই বলে নি?
একটি দিনের গল্পে পরিচালক মা - মেয়ের সম্পর্কের গভীর শূন্যতা গুলো তুলে ধরেছেন। ব্যস্ত নাচিয়ের কাছ থেকে অদিতি পায়নি সময়, কেবল আর্থিক সহায়তায় মায়ের ভূমিকা নিভানোর দায়ভার তাই মায়ের উপর চাপায়। শুধু পড়াশোনার খরচ চালিয়ে আর নামীদামী প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে যে যথাযোগ্য মা হওয়া যায় না অদিতির আকুলতায় বারবার তা উঠে আসে।
ছোট বেলায় অদিতি অপেক্ষা করে থাকতো মা তাকে নাচ শেখাতে ডাকবেন বলে - ব্যস্ত মায়ের সেই অপেক্ষা বোঝার সময় হয় না। অদিতি অপেক্ষা করতো বাড়ি ফিরে মা তাকে স্নেহের পরশ বুলাবেন বলে - সারাদিনের কাজে ক্লান্ত মায়ের সে সময় হয় না।
বাবার গভীর স্নেহের জন্য আকুলতা আর মায়ের এহেন আচরণ তার মাঝে মায়ের প্রতি ক্ষোভের পাহাড় তৈরি করে।
চলুচ্চিত্রে মা - মেয়ের সম্পর্কের দূরত্ব তুলে ধরা হয়েছে কোন অতিরঞ্জিত আবেগ সর্বস্ব দৃশ্যের অবতারণা না করেই। একে অপরকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা থেকেই যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলছিলেন দিন জুড়ে। যার সমাপ্তি হয় অদিতির তোলা শত অভিযোগে আর তার মায়ের কখনো সেই অভিযোগ সমূহ খণ্ডানোর চেষ্টায়, কখনো নিরুত্তর কান্নায়।
সব শেষ শুভ পরিণতির দিকেই হয়তো ইঙ্গিত করেছেন পরিচালক, কিন্তু সমস্ত চলচ্চিত্র জুড়ে সম্পর্কের এমন সাবলীল অথচ গভীর রূপায়ণই বোধকরি ঋতুপর্ণকে করে তুলেছে অনন্য।
© Poroma Shome

No comments