কেদারা : নরসিংহের একাকিত্বের শব্দ স্পর্শ করেছে মনস্তাত্ত্বিক জগৎ

কেদারা চলচ্চিত্রের পোস্টার  


এক কাপ চা, তিনটে বিস্কুট আর একটা তৃপ্তির চুমুক - সকালটা ঠাকুমার সঙ্গে দিব্যি তৃপ্তি সহকারেই কেটে গেলো নরসিংহের৷ তবে ঠাকুমা নেই স্ব-শরীরে। মননে, কণ্ঠে ছোটবেলার ঠাকুমাকে নিজের মাঝ বয়সেও জাগ্রত করে রেখেছেন নরসিংহ৷ 

একাকিত্বের গুমোট অন্ধকারে হাতড়ে বেরোচ্ছেন জীবন নামক সমুদ্রতে৷ ব্যর্থতা - দরজা, জানালা বন্ধ ঘরের প্রতিটা দেয়ালে ঝুল জমতে জমতে শরীরেও শ্যাওলা জমে গেছে। ছেড়ে চলে গেছে স্ত্রী-সন্তান। কিন্তু জীবন তো রয়ে গেছে! ছেড়ে তো যায় নি - নরসিংহ কি পারে জীবনকে পেছনে ফেলে চলে যেতে? পারে না বলেই জীবনে এই বদ্ধঘরে রোজ বাঁচিয়ে রাখার উপাদেয় দিয়ে যাচ্ছে। রূপচাঁদা মাছের ঝাল, সাদা আলুর তরকারি - পিসি, ঠাকুমার সঙ্গে আলাপ থেকে শুরু করে বেড়াল, বাঘ সব কিছুই হরবোলা নরসিংহকে জীবনের সঙ্গে গাঁছড়া বেঁধে দিয়েছে৷ টেলিফোনের ক্রিংক্রিং শব্দ, রিসিভার কানে চেপে ধরতেই কেমন নিস্তব্ধতা - এসবকে নিয়ে যখন হোঁচট খেয়ে পড়বার জো - তখন এলো অনাকাঙ্খিতভাবে 'কেদারা'। জমিদারি 'কেদারা' নিরসিংহকে সত্যিই সিংহের রূপে দাঁড় করিয়ে দিলো সক্কলের সম্মুখে৷ তিনটে অক্ষর - কেমন করে বদলে দিলো জীবন। দেয়ালের চল্টি উঠে যাওয়া ঘর নিমিষেই জমিদারিত্বের হাওয়া লেগে রাজকীয়তার আদলে হাজির হলো যেনো! নরসিংহের সিংহময়ী গলার স্বর শুনলো পাড়ার ছোকড়া থেকে এমএল পর্যন্ত।
তালা বন্ধ ঘরটা এতদিন অনাদরে পড়েছিলো যেখানে - দরজার কপাট খুলতেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালো হরবোলা নরসিংহ। চাঁদ-তারাদের মিলন মেলায় - জীবনের আরেক রঙ ছড়িয়ে গেলো শরীরময়৷ কল্পনার চাদর সরিয়ে হরবোলার যৌবন নাড়া দিলো - বৃষ্টির জলে স্ত্রীর খোলা শরীরে ফোটাদের নাচন দেখে কেমন করেছিলো নরসিংহের চোখজোড়া? চিত্ত!
তবে সব যে ওই কেদারা'কে ঘিরে। ওখানেই যে সব কিছু উত্থান। তাই পরিণতিটা লেখা হলো কেদারা'র পতনে।
তবে সে সুর যে কত করুণ - তা একবার শুনতে আপনাকে কান পাততে হবে কেদারা'র গায়ে।
এ যেনো দৃশ্যের খেলা নয় - শব্দের ঝংকারে সাজিয়ে তোলা হয়েছে এক জীবনের গল্প।

অভিনয়ঃ পুরো সিনেমা জুড়েই কৌশিক গাঙ্গুলী। নরসিংহ চরিত্রে কৌশিক গাঙ্গুলীর অনবদ্য অভিনয় চিত্রনাট্য ও সংলাপকে দিয়ে ভিন্নতর প্রাণ। একাকিত্বের গল্পটা যেনো দ্বিগুন তৃপ্তির করে তুলেছে কৌশিক গাঙ্গুলীর অনবদ্য অভিনয়।
কৌশিক গাঙ্গুলীকে সমর্থন যুগিয়ে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন রুদ্রনীল ঘোষ। একাকিত্বের ছাঁপ গায়ে মেখে পুরনো আসবাবপত্র নিয়ে কাটিয়ে দেয়া কেষ্ট চরিত্রটিই আলাদা মাত্রা জুগিয়েছে নরসিংহের চরিত্রকে৷ অন্যান্য চরিত্রগুলোর ক্ষুদ্র পরিসরপ আগমন চোখে না লাগলেও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এদেরকে অস্বীকার করবার জো নেই।

সিনেমাটোগ্রাফিঃ গল্পের পাশাপাশি নজর কাড়ার মত সিনেমাটোগ্রাফির জন্য শুভঙ্কর ভারকে আলাদাভাবে কিছু না বললেই নয়। দূর্দান্ত কিছু ফ্রেমিং সহ গোটা চিত্রগ্রহণটাই সিনেমার প্রাণকে করেছে সজীব।

সঙ্গীতঃ সিনেমার ধারায় যেমন গান নিয়ে বেশ করে একটা গল্প বলা দেখেছি, 'কেদারা' তার বিপরীতমুখী। তবে সিনেমায় আবহসঙ্গীত ছিলো অন্য রকম৷ অরিজিৎ সিংয়ের করা আবহসঙ্গীত সিনেমায় মোড়ে মোড়ে যে দোলা দিয়েছে, মনস্তত্ত্বে যে শিহরণ দিয়েছে তার জন্য অরিজিৎ সিংকে ধন্যবাদ।

মন্তব্যঃ ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের প্রথম সিনেমা 'কেদারা'। শ্যাওলা ধরা, ঝুল পড়া জীবনের দেয়াল টপকে তৃপ্তির নাগপাশ ছুঁয়ে বেঁচে থাকার যে আওয়াজ তিনি তুলতে চেয়েছেন - সে বিষয়ে সার্থকতার ছাঁপ রেখেছেন তিনি। তথাকথিত সিনেমার ধারা ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন কেদারা নিয়ে - গল্প বলেছেন আয়েশ করো বসে। তবে কেবল গল্প নয়, যে শব্দ তিনি বুনেছেন পরতে পরতে সো জাদু স্পর্শ করেছে দর্শকের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ৷ অভিনয়ে কৌশিক গাঙ্গুলী ছাঁপিয়ে গেছেন বিগত সময়ের নিজেকে৷ সিনেমায় নরসিংহ চরিত্রের দ্বারা একটা দ্বীপ গড়েছেন তিনি। যেখানে বর্তমান বাঙালী অভিনেতাদের মধ্যে তিনি একমাত্র অন্যতম চরিত্রাভিনেতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। সে দ্বীপে তারা হয়ে আকাশ রাঙিয়েছেন শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়ের সংলাপ। উজ্জ্বল, সুগন্ধী সংলাপের জাদু দিয়ে দর্শককে বেঁধে রেখেছেন পুরো এক ঘন্টা তিপান্ন মিনিট৷

লিখেছেনঃ শাকিল মাহমুদ

No comments

Powered by Blogger.