কাঠবিড়ালী : ভালোবাসা তলিয়ে যায় যৌনতার মাঝে, সঙ্গে নিয়ে যায় জীবন
![]() |
| কাঠবিড়ালী চলচ্চিত্রের পোস্টার |
প্রথমে নিজের কথা দিয়েই শুরু করবো। অফিসের অন্যান্য দিকের ব্যস্ততার কারণে এবং যেহেতু আমি একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে যুক্ত সেহেতু সে সময়টায় নাটকের শো থাকায় হলে গিয়ে কাঠবিড়ালী দেখা হয় নি। পরবর্তীতেও নানা কারণে দেখা হয় নি বলে আফসোস অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু দেরি করে হলেও সিনেমাটি দেখেছি। দেখে উলবদ্ধি করছি যে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে গল্প বলার মানুষের যে অভাব সে অভাবের ঘরে নিয়ামুল মুক্তা গল্পকার হিসেবে নাম লিখিয়েছেন।
এবার চলুন সিনেমায় ফেরা যাক।
সদ্য কাঠবিড়ালী সিনেমাটি দেখেই অনলাইনে সিনেমা নিয়ে বেশ কয়েকটি রিভিউ পড়লাম। কিন্তু যুতসই রিভিউ পাই নি একটাও। সে যাক গে! সিনেমা নিয়ে দু/চারটে কথা লিখবার পূর্বেই যে কথাটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তা হলো, 'ভালোবাসার মন যখন তলিয়ে যায় যৌনতার শরীরের মাঝে - বিশ্বস্ত মানুষটি হয়ে উঠে অচেনা।
এ সিনেমার গল্পের সঙ্গে, মূখ্য চরিত্রদ্বয়ের সম্পর্কে এমন কথা বললে নিশ্চই অসংলগ্ন কিছু বলা হবে না!
সিনেমাঃ কাঠবিড়ালী
পরিচালনাঃ নিয়ামুল মুক্তা
অভিনয়েঃ আসাদুজ্জামান আবির, অর্চিতা স্পর্শিয়া, সাইদ জামান শাওন, শিল্পী সরকার অপু, একে আজাদ সেতু, হিন্দোল রায় সহ আরো অনেকে
গল্প নিয়েঃ আমরা গ্রামের গল্পে সচরাচর যে চিত্রায়ন সিনেমায় উঠে আসতে দেখেছি বিগত সময়ে, কাঠবিড়ালী তার উল্টো পথে চলা একটি গল্প। গ্রামের সরল প্রাণে প্রেমের হাওয়া ছাড়াও রহস্যময়তার যে উল্টো হাওয়া বয় এবং তা জীবনকে উলটপালট করে দেয় নিমিষেই - নিয়ামুল মুক্তা সে গল্পটাই তুলে ধরেছেন সকলের সামনে৷ জটিল করার কোনো প্রয়াস তিনি দেখান নি৷ তবে সরলতার পেছনে বিশ্বাসঘাতকতার ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে - সে বিষয়টা নির্মাতা বহমান নদীর জলের মত স্বচ্ছ করে তুলে ধরেন নি। আর সেটা করেন নি বলেই সিনেমাটি গত একযুগে নির্মিত সিনেমাগুলোর মধ্যে সেরা দাবিদার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিচালক হিসেবে নিয়ামুল মুক্তা যতটা না প্রশংসার দাবিদার তারচে বেশি দাবি করেন গল্পের জন্য।
অভিনয় নিয়েঃ সিনেমায় ক্লাইমেক্সটা দেন আসাদুজ্জামান আবির। দোদুল্যমান চরিত্র তিনি। আসলেই তিনি বোকা নাকি গ্রামের সহজ-সরল একটি ছেলে, যে বিশ্বাস এবং আস্থার উপর বেঁচে থাকতে চেয়েছে সব সময়। কিন্তু তার বিশ্বাসের ঘরে যখন আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো, ফুঁসে উঠলো সে - সরলতা মূহুর্তে মিলিয়ে গিয়ে প্রতিশোধ পরায়ণতা তাকে করে তুললো হন্তারক! আসাদুজ্জামন আবিরের অভিনয়ে গোটা সিনেমা জুড়েই ছিলো চোখে লাগার মত৷ সাধারণ, সহজ-সরল ছেলে থেকে ড্রাইভার্ট করে একজন খুনিতে পরিণত হওয়ার বিষয়টা যেমন চরিত্রের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে তেমন মনঃস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে আবিরের অভিনয় গোটা সিনেমায় ভিন্ন রকম ছাঁপ ফেলেছে৷ অর্চিতা স্পর্শিয়া এ সিনেমায় নিজেকে ছাঁপিয়ে তার সেরাটুকু দিন য়ার যে প্রয়াস করেছে, তাতে সে সফল হয়েছে৷ কিন্তু সিনেমা জুড়ে স্পর্শিয়ার অভিনয় সঙ্গ দিয়েছে তার প্রধান সহ-অভিনেতা আবিরকে। সেক্ষেত্রে স্পর্শিয়া বাড়তি কোনো কিছু ফলাতে যায় নি বলে অভিনয় ছিলো সাবলীল৷
অন্যান্য চরিত্রগুলোও ছিলো নিজেদের মত করে। বাড়তি কিছু করে দেখাবার তাড়া ছিলো না তাদের কারোরই।
সঙ্গীত নিয়েঃ ইমন চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনায় সিনেমার গানগুলো ছিলো অনবদ্য। ইউসুফ হাসান অর্কের সুরে সুন্দর কন্যা (কণ্ঠঃ শফি মণ্ডল) ও পতি (কণ্ঠঃ ইমন চৌধুরী ও দিলশাদ নাহার কনা) বেশ জনপ্রিয় এবং ভিন্ন স্বাদে আবির্ভূত হয়েছে।
সিনেমাটোগ্রাফিঃ সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে বলতে গেলে বেশ কয়েকটি দৃশ্য ভালো লেগেছে৷ সবে ড্রোনের ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে৷ যেগুলো না নিলে তেমন কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না। কেননা, পাট ক্ষেতের যে দৃশ্য এবং হাসুর গোসল করার যে দৃশ্য ড্রোনে নেয়া হয়েছে এদুটো সিনেমায় ভিন্নমাত্রা ও মানে তৈরী করলেও বাকি কয়েকটা দৃশ্য পরিবারের বাড়তি সন্তানের মতই মনে হয়েছে। তবে সব কিছু ফেলে আদিত্য মনির প্রশংসার দাবিদার বৈকি!
মন্তব্যঃ গ্রামগঞ্জের সরল প্রেম, ভালোবাসার রসে ভরা সংসারের গল্পে - বিশ্বাস ভাঙা তিক্ততা এবং জীবন-ভালোবাসার প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে খুনের যে রহস্য নিয়ামুল মুক্তা দিয়েছেন তাকে বিশ্লেষন করে বলতে গেলে বলতে হবে, দুপুরে ভাত-মাংস খাওয়ার পর বাটি ভরে ক্ষীর খাওয়ার যে ব্যবস্থা তিনি করলেন তা প্রশংসনীয় বটে৷ কিন্তু গল্পকার হিসেবে নিয়ামুল মুক্তার যে মুন্সিয়ানা পেয়েছি তা অনন্য।

No comments