মন্ত্রের তফাতে ইরফান দানবীয় অভিনেতা হয়েছেন: অনির্বাণ ভট্টাচার্য


অভিনেতার মৃত্যু

"ইরফান খান। স্কিলফুল, কিন্তু রিপিটেটিভ" -জনৈক।


সবে সংবাদ টা এসেছে। শোক তখনো পুরোপুরি কর্তৃত্ব কায়েম করেনি। দিন-নামচা তখনো থমকে যায়নি,দেরি করে ঘুম থেকে উঠে দেরি করে করা ব্রেকফাস্ট তখনো মুখের মধ্যে কচর-মচর করছে,স্বভাব বসত টুইটার,ফেসবুকে আশেপাশে শোকের জল মাপতে গিয়ে,এক যুবার এই লেখাটি (উপরে ইনভার্টেড কমা'র মধ্যে যেটি আছে) চোখে পড়ে। আমি এই যুবা কে চিনি না,তবে অন্য পরিচিত'র সূত্রেই জানি,তিনি থিয়েটার বা সিনেমায় বা উভয়েই অভিনেতা হিসেবে যুক্ত।
এইটা দেখার পরেই প্রথম শোক আমার ঘাড়ে কামড় বসায়।
আমি এই লেখায় রিপিটেটিভ,স্কিলফুল,এইসব শব্দ ও তার সাথে সদ্য মৃত অভিনেতার সম্পর্ক,আমার কাছে ব্যপার টা এরকম, না মানে, সবারই তো একটা মত আছে, এইসব অশেষ, অক্লান্ত, অনন্ত নোংরা রেসলিং করতে চাইব না কখনোই, এক যুবা কে ভার্চুয়াল লিনচিং এর আওতায় আনার উদ্দেশ্যও নয় আমার।
আসলে এই লেখাটি পড়ে আমি বুঝতে পারলাম,কোন পৃথিবী থেকে ইরফান বিদায় নিলেন।
আমরা এমন এক পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছি, যেখানে আমাদের চলতে হয়, বলতে হয়, সর্বক্ষেত্রে, সর্বক্ষণ। মানে, দিনে দিনে সেটা আমাদের চয়েসের আওতার বাইরে চলে গেছে। অপশন ধীরে ধীরে কমপালশনে পৌঁছেছে। ফলত, যেহেতু প্যারামিটার ছোট হয়ে আসছে, তাই সুক্ষ রেখা গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। বলতে চাইছি,অভিনয় হোক, ক্রিকেট হোক, রাজনীতি বা একটা রেস্টুরেন্ট, সেলুন, যেটা ক্রমাগত চলতে থাকছে,অবিরাম। এবং অসংখ্য 'বলা' দিয়ে সেই 'ক্রমাগত' চলা টা রেজিস্টার্ড হতে থাকে। এই রেজিস্ট্রেশন টা খুবই ইম্পরট্যান্ট, যা রেজিস্টার্ড নয়,তা চলা নয় বেশিরভাগ মানুষের কাছে। এবং নতুন ইতিহাস এই রেজিস্ট্রেশন এর ওপর ভিত্তি করেই লেখা হবে,যা নিঃসন্দেহে পুরাতন পৃথিবীর থেকে ভিন্ন হবে। এবার কেন ভিন্ন, কোথায় আলাদা, আগে কি ছিল, এখন কি নতুন আছে, এই বিশ্লেষণ-ধর্মী আলোচনার যে রীতি,তার মধ্যে একটা থামা আছে। যে কোনো গাণিতিক আবিষ্কারের গোড়ায় শূন্যের যে গুরুত্ব, সেইপ্রকার। কিন্তু সেটা অনেক সংখ্যক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তাদের কাজ অবিরাম বলা,বলে চলা, বলতে থাকা। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এখনো ভাবেন এ তাদের চয়েস, আবার অনেকেই এটা বুঝে মেনেও নিয়েছেন যে এ তাদের কম্পালশন। বাধ্যতা।

তবু, এমন বহু সংখ্যক মানুষ আছেন,যারা উক্ত রেজিস্ট্রেশন এর তোয়াক্কা না করে কাজ করে চলেন,চলেছেন,চলবেনও। আজকের দিনে যাকে বা যাদের এক্সক্লুসিভ বা বিশেষ বলা যায়। ইরফান তেমনি এক বিশেষ শিল্পী ছিলেন।
আমি যে সামান্য কদিন অভিনয় করছি, চর্চা করছি, তাতে আমি যাবতীয় প্রয়োগ শৈলীর ওপরে একটাই মোটিভেশন আঁচ করতে পেরেছি, যে মানুষের প্রতি অদম্য ভালোবাসা না থাকলে ভালো অভিনেতা কিছুতেই হওয়া যায় না, অথচ তর্ক টা চিরকাল উল্টো বিষয় নিয়ে হয়ে এসেছে,"ভালোমানুষ না হলে অভিনেতা হওয়া যায়না" গোছের ফালতু, সংস্কারাচ্ছন্ন, আকাট মর্মে।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তার খলতার প্রতি, নীচতার প্রতি, মহত্বের প্রতি, জাজমেন্ট, সংস্কার, ভক্তি, সাহস, ভীরুতার প্রতি কৌতূহলী শিশুর মত আকৃষ্ট ও সহমর্মী না হলে অভিনেতা হওয়া যায় না। কারণ অভিনেতাকে এই সব,এর চেয়েও বেশি মাত্রাভেদে অন্য মানুষকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হয়।
এই ভালোবাসার কাছে এসেই নব্য পৃথিবী বিপদে পড়ে যায়,ক্রমাগত বলা ও চলা ও তার রেজিস্ট্রেশন এর যে হিসেব তা হোঁচট খায়।
ইরফান খান কোনো বাঘের সঙ্গে সমুদ্রে দিন কাটাননি, এমন হয়তো কেউ নেই তার জীবনে যে ইরফান কে অমন অসম্মানজনক,অবজ্ঞা ভরা বিদায়ের সাক্ষী করেছিল রিচার্ড পারকারের মত, কিংবা হয়তো আছে। কিন্তু ওই ঘরের মধ্যে বসে, শ খানেক লোক ভর্তি ইউনিটের সামনে, তাক করা কালো ক্যামেরার সম্মুখে, একটি রুগ্ন বাঘের সঙ্গে আবেগহীন,অবজ্ঞাভরা বিদায়ের গল্প তিনি যেভাবে বলেন, মাথায়, মনে, শরীরে এক সমুদ্র ভালোবাসা না থাকলে ওই ভাবে তা বলা যায় না। আমরা পারি না, কারণ আমাদের ভেতর ওই পরিমাণ ভালোবাসা নেই, মানুষের প্রতি, সৃষ্টির প্রতি, জীবনের প্রতি। আমরা কেবলই পছন্দ, অ-পছন্দের তালিকা তৈরি করতে থাকি,সারাদিন বলতে থাকি, এটা ভালো লাগে, এটা লাগে না। বিচার করতে থাকি অ-ক্লান্ত ভাবে। আমাদের এক্সিস্টেন্স সিস্টেম আমাদের সেভাবেই চালায়, আমি সেটা মেনেও নিয়েছি, আমি কখনো ইরফান খানের মত অভিনেতা হতে পারব না, কারণ আমি নিজেকে নিজেই খর্ব করে নিয়েছি। দাসত্ব স্বীকার করেছি। কারণ আমি চলতে চেয়েছি, চলা কে মন্ত্র করেছি, তারমধ্যে যা, যেটুকু আসে, তাকে গ্রহণ বা আহরণ করার চেষ্টা করছি, আর ইরফান মন্ত্র করেছেন গ্রহণ বা আহরণ কে, সেই মন্ত্রই তাকে চালিয়েছে।
মন্ত্রের তফাতে ইরফান দানবীয় অভিনেতা হয়েছেন, আমি, আমরা বামন চেষ্টাকারী হয়েছি।

আমার ধারণা আমাদের বেদনা হবে,কিন্তু আমরা শোক করতে পারব না,কারণ আমরা শোক করতে ভুলে গেছি, কেউই বলতে পারব না কি সেই নৈঃশব্দ্য বা নুয়ে থাকা, যাকে শোক বলা চলে, বা হ্যামলেটের পাগলামি, পঞ্চকের উদ্ভট নাচ কেও আমরা শোকের তালিকা থেকে অসভ্য বলে বাদ দিয়েছি।
আমাদের পার্সেপশনে আমাদের যে সভ্যতা,তাতে শোক নেই,বসে থাকা,কিছু না বলা নেই। আমাদের গাণিতিক সভ্যতায় 'শূন্য' বলে কোনো সংখ্যা নেই।
আমরা এরকমই, আমরা প্রতিদিনই এরকম করি, করতেই থাকি। আমরা, আমাদের সমস্ত স্বভাব "রিপিটেটিভ"। তাই আমরা ইরফান খান কেও,আরো অনেককে,অনেককিছু কে "রিপিটেটিভ"ই বলতে থাকব। আমি জানি আজ রাতে এই বলার অধিকার নিয়েই আমরা ঘুমোতে যাব, কাল সকালে ঘুম ভাঙবে এই অধিকার সমেতই।
আমাদের পেশা: চলতে থাকা
আমাদের কাজ : বলতে থাকা

যাই, স্নান করি, ভাত খাই, খান কতক বাইট নিশ্চয় দিতে হতে পারে, কাল লাইভ আছে। মোদ্দা কথা, বহু রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পড়ে আছে, প্রতিটায় স্ট্যাম্প দিতে হবে, আমি আছি, আমি আছি, আমি আছি।
ইরফান খান নেই।
ইরফান চলে গেলেন।
পৃথিবীর দৈত্য-মুক্তি ঘটছে। পৃথিবী শুধু বামন আর ভাইরাসের হবে।আমরা ছোট হতে হতে হতে হতে যেদিন কোভিড বা অন্যান্য ভাইরাসের মত অদৃশ্য-প্রাণ হব, যেদিন ফাঁকা রাস্তায় উড়বে সব রেজিস্ট্রেশন ফর্ম, যেদিন না থাকবে কোনো স্কিল,না থাকবে রিপিটেশন,সেদিন হবে মজন্তালী,সেদিন হবে নরক গুলজার।
সেদিন না থাকবে যম,না থাকবে নচিকেতা
সেদিন পৃথিবী আবার শান্ত হবে
ততদিন পর্যন্ত চলুক,যেভাবে চলে।

ভালো থাকুন সকলে।

© অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ফেসবুক পেইজের টাইমলাইন থেকে।  

No comments

Powered by Blogger.