সিনেমার ভবিষ্যৎ ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশ!




কিছুদিন আগে কলকাতার নির্মাতা অভিরূপ ঘোষ দাদার সঙ্গে করোনার কারণে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি কি ধরণের ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো। তার প্রেক্ষিতে জানতে চাইলাম, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম-ই ভরসা হবে কিনা! 

তিনি তখন বললেন, সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যত সংকটই আসুক সিনেমা হল থাকবে। আমিও দাদার ক্থার সঙ্গে একমত। কিন্তু বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপট আর কলকাতা সহ সমগ্র ভারতের প্রেক্ষাপটে ভিন্নতর। 
বিষয়টা একটু উদাহরণসহ বলি। ধরুন কুদ্দুসের ও আকাশের একটি কোম্পানি আছে। যারা ভাত উৎপাদন করে। এদিকে কুদ্দুস ভাতের সঙ্গে পোলাও, কোরমা সহ নানা মুখরোচক খাবার উৎপাদন শুরু করলো এবং জনগণের মাঝে নতুন নতুন চাহিদা তৈরী করে নিজের একটি শক্তপোক্ত জায়গা করে নিলো। 
অন্যদিকে আকাশ সেই প্রথম থেকে ডাল-ভাত উৎপাদন করছে। এখনো সেই ডাল-ভাতেই রয়েছে৷ সুতরাং ডাল-ভাত কুদ্দুসের কোম্পানিতেও পাওয়া যায়, সঙ্গে মুখরোচক খাবারও। ফলে জনগণ নতুন নতু স্বাদের খাবারের দিকে ঝুঁকলো এবং আকাশের কোম্পানি ধীরে ধীরে রসাতলে যেতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে আকাশ তার কোম্পানিতে বড়সড় একটা তালা ঝুঁলিয়ে দিলো এবং বললো পাঁচ তারকা হোটেল হবে এখানে। সঙ্গে একটা রেস্টুরেন্টও। 
অর্থাৎ বাঙলাদেশের সিনেমার অবস্থা আকাশের কোম্পানির মত। এরা শুরু থেকেই ডাল-ভাত নিয়ে আছে, এখনো তারা ডাল-ভাতেই হত্তে দিয়ে পড়ে আছে। মানুষ যে ডাল-ভাত ছাড়াও এখন নানা ধরণের খাবার খাচ্ছে এবং খুবই সহজলভ্যে তা এদের কল্পনায়ও জায়গা করতে পারছে কিনা তা আমার বোধগম্য নয়৷ ফলে পৃথিবীর অন্য কোথাও সিনেমা হল বন্ধ না হলেও বাঙলাদেশে ব্যাপক পরিমাণের সিনেমা হল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে এবং এই করোনাকালীন সংকটের পর তা আরো দ্বিগুন ভাবে হবে বলেই মনে করি। কোম্পানি যদি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় না থাকে তাহলে কোম্পানির দরজা খুলে রাখা না রাখা সমান কথা। 

বিশ্বে ইতোমধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের একটি বিপ্লব ঘটে গেছে৷ অবশ্য এটি সময়ের চাহিদা বটে। তবে এ বিপ্লবে বাঙলাদেশের কি অবদান রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও উত্তর মিলছে না! কারণ এখন পর্যন্ত বাঙলাদেশ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমার হেডম দিয়ে কোনো অবস্থান পায় নি। দু/একটি সিনেমা বাদে (তাও হয়তো ব্যক্তিগত হেডমে) বেশির ভাগই প্রতাপশালী নির্মাতা/লবিং করে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এটা কি সিনেমার ভবিষ্যতের জন্য ভালো! ধরুন আজকে সত্যজিৎ রায় সিনেমা বানিয়ে অস্কার পেয়েছে৷ তার মানে কি তিনিই একমাত্র ভালো নির্মাতা? উনি ছাড়া আর কোনো নির্মাতা তৈরী হবে না? নতুন কোনো নির্মাতা সত্যজিতের চেয়ে ভালো সিনেমা বানাতে পারবে না? এমনো তো হতে পারে একজন নতুন নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর চেয়ে দশগুন ভালো একটি সিনেমা বানিয়ে ফেলার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু তাকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। 

আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে শাকিল একটা সিনেমা বানিয়েছে। ভালো করেছে, পুরস্কার-টুরস্কার পেয়েছে - তার মানে সেই-ই সিনেমা বানানোর যোগ্য। অন্যদিকে কালাম সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখে, গল্প নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে - ওকে দিয়ে কিছু হবে না! ভাই, শিল্প পুরোটাই এক্সপেরিমেন্টাল৷ জীবনানন্দ দাশ একটি কবিতা লেখার পর আগের অনেক শব্দের, লাইনের জায়গায় অনেকগুলো শব্দ/লাইন লিখে রাখতেন। দেখতোন কোন শব্দ/লাইন ওই কবিতায় ঠিকঠাক যায়। অর্থাৎ তিনি এক্সপেরিমেন্ট করতেন। আজকে যে সিনেমাটি বানালাম কালকে এই সিনেমার অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তী সিনেমা বানাবো। সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে নির্মাতার যোগ্যতার পরিমাপ করলে পৃথিবীতে কোনো শিল্পই দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো না বা বিকশিত হতো না৷ 
ফলে কাজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে৷ ব্যবসায়েও এক্সপেরিমেন্ট হয়। লাফ দিয়ে লাভ/ক্ষতির চিন্তা হয় না। সুতরাং সিনেমায় প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি বিপুল এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করতে হবে৷ নয়তো বাঙলাদেশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা অসম্ভব।

ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করা নির্মাতারাই বৈপ্লবিক ভূমিকায় থাকবে। অবশ্য কবে নাগাদ এদেশে এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবে আর কবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে জায়গা পাবে তা নিয়ে বিস্তর দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। আর এ দ্বিধা নিয়েই লেখার ইতি ঘটলো।

No comments

Powered by Blogger.