মৃণাল সেনের 'ইন্টারভিউ'

ইন্টারভিউ (১৯৭১) চলচ্চিত্রের পোস্টার 



একজন নির্মাতা কতটা সফল তা নির্ধারিত হয় তিনি তার চলচ্চিত্রে কতটা জীবনের প্রতিফলন ঘটান আর সেই প্রতিফলন এর যথাযথ বাস্তবায়নে সিনেমাটিক টেকনিক এ কি নতুনত্বের আশ্রয় নিয়ে থাকেন তার উপর। 

'ইন্টারভিউ' নামটা শোনে আমরা অবশ্যই অনেকে ধরে নিয়েছি কোন ইন্টারভিউ সম্পর্কিত ঘটনার আলোকপাত হবে এ চলচ্চিত্রে। আমাদের ধারণায় আসলেই কোন ভুল নেই। এক নিম্ন মধ্যবিত্ত যুবকের ইন্টারভিউ এর আখ্যানই তুলে ধরা হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। কিন্তু সাধারণের  ধারণার  বাইরে ছিলো ছবিটির গল্প বলার ধরণ। 

প্রথমেই পরিচালক আমাদের সাথে পরিচয় ঘটান এক নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির তিন সদস্যের। তাদের মাঝে একজন আমাদের রঞ্জিত যার ইন্টারভিউ উপলক্ষ্যে মা আর দিদির চিন্তা,উদ্দীপনার শেষ নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির যদি আয় দিগুণেরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় উত্তেজনা অধিক হওয়ার কথাই বৈকি। একমাত্র ভালো জুতা জোড়া মা যত্ন করে তুলে রেখেছেন তার নিরাপদ বাক্সে আর ইন্টারভিউ উপলক্ষ্যে সাহেবী পোশাক পরার অনুশীলন রঞ্জিত শুরু করেছে পুরাতন নেতিয়ে যাওয়া টাই পরার অপচেষ্টার মাধ্যমে।  সব যখন ঠিক ঠাক চলছিলো  তখন সমস্যা বাঁধায় লন্ড্রি ওয়ার্কার দের স্ট্রাইক। সেই লন্ড্রিতেই যে পড়ে আছে রঞ্জিতের বহুল  কাঙ্খিত স্যুট খানা, যেটা তার ইন্টারভিউ এ পরে যেতেই হবে, সাহেবী ঢং এর পোশাক ছাড়া এই ইন্টারভিউ এ সফল হওয়ার আর কোন সুযোগ নেই।

'ইন্টারভিউ' চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য   


পোশাকের খোঁজে রঞ্জিত বেরিয়ে পড়লো। ভীষণ শ্রমের পর যোগাড় ও হলো পোশাক কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ঘটনার ফেরে তাকে ইন্তারভিউ দিতে হলো বাঙালিয়ানায় মোড়ান ধূতি - পাঞ্জাবি পরে। বলাই বাহুল্য বাবার বন্ধুর  সহায়ক ভূমিকা সত্ত্বেও কেবল পোশাকের কারণে তার চাকরিটা হলো না। 

এই চলচ্চিত্রে যে রঞ্জিতকে মৃণাল সকাল থেকে ক্যামেরা নিয়ে অনুসরণ করছেন বলে জানিয়েছেন সেই রঞ্জিত একা একজন না। প্রত্যেক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার যুবক এর প্রতিচ্ছবি । যার একমাত্র ভাল জুতোজুড়া মা পরম যত্নে তুলে রাখেন কোন বাক্সে, যার মায়ের কাছে লন্ড্রির রিসিপ্ট জমা থাকে এবং মা সংসারের  হাজারো ছোট ছোট রিসিপ্টের ভীড়ে সেই প্রয়োজনীয় ছোট্ট কাগকের টুকরাখানা খুঁজে পান  না, যার বন্ধু তাকে সাহায্য করে  নিজে চাকরি পাবার আশায়, যার প্রেমিকা স্বপ্ন দেখে সকল লেটেস্ট জিনিসে ফ্ল্যাট সাজানোর, যে জীবনে প্রথম  আনাড়ি হাতে টাই বাঁধার চেষ্টায় বারংবার ব্যর্থ হয়। এই রঞ্জিত তখনকার কলকাতায় ছিলো এখনকার কলকাতাতেও আছে।

আমরা চলচ্চিত্রের শেষের দিকে রঞ্জিতকে দর্শকের মুখোমুখি হতে দেখি । তাকে বলতে শুনি  -
"জানেন... জানেন আমার কিন্তু চাকরিটা হতে পারতো, হতো, হওয়া উচিত ছিলো
আমি নাকি ক্লাউন, আমি নাকি সং সেযে  গিয়েছিলাম। মানে ধূতি- পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিলাম। আমার ধূতি , আমার পাঞ্জাবি , কি অন্যায় বলুন তো?
... অথচ আমার আর সব কিছুই ছিলো। বিদ্যে, বুদ্ধি , যোগ্যতা - ওদের হিসাব মতো সব। শুধু ছিলো না পোশাক । 
... আচ্ছা কি অন্যায় বলুন তো, কত বড় ফাঁকি, মিথ্যে । কত বড় একটা ভূয়া ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের থাকতে হচ্ছে, আর এ সমস্ত আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।"

চলমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এমন আঘাত আর কোন ভারতীয় চলচ্চিত্রকার এমন তীব্রভাবে করতে পারেন নি।
ব্রেখটিয়ান কৌশল, ক্লোজ শটের ব্যবহার,  সম্পাদনায় মন্তাজ চলচ্চিত্রের ভাষা নতুন ভাবে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করেছে। সাহেবী পোশাকের মেটাফোর আর সামাজিক  আন্দোলনের দৃশ্যাবলির সংযোজন এই চলচ্চিত্রকে দান করেছে দার্শনিক মাত্রা ।
চলচ্চিত্র যে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে মৃণাল সেন আমাদের সে শিক্ষায় দিয়েছেন আজীবন।

জন্মদিনে প্রণতি জানাই মহান এই নির্মাতাকে।

লিখেছেনঃ পরমা সোম

No comments

Powered by Blogger.