পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভয়ের নাম 'বুলবুল'
ঘাড় মটকে দেয়া বা পা মচকে কিংবা ভেঙে ফেলে ঘরে নারীকে বন্দি করে রাখার প্রথা সেই সুপ্রাচীন কালের। তারই এক খন্ড চিত্র অঙ্কিত হয়েছে আনুশকা শর্মা প্রযোজিত নেটফ্লিক্সের নতুন সিনেমা 'বুলবুল'-এ।
আনুশকা শর্মার প্রযোজিত সিনেমাগুলো নিয়ে বিশদ আকারে তেমন কিছু বলবার প্রয়োজন না হলেও এ কথা বলতে হয় যে, বলিউডের তথাকথিত সিনেমার চলমান ধারার বাইরে গিয়ে সমাজের কালো অধ্যায় এবং তার একটি প্রতিবাদী চিত্র তিনি বরাবর আঁকতে চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে নির্যাতিত নারী - তার সিনেমার মূল বিষয় হয়ে উঠেছে এবং সে চিত্রের সফল চিত্রায়নে ফুটে উঠেছে এক প্রতিবাদী নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে। আমাদের সমাজে নারী প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার। সমাজ, পরিবার, সামাজিক উপকরণ দ্বারা সে নিপীড়নের মাত্রা যখন সীমারেখা অতিক্রম করে গিয়েছে তখনই নারী ফুঁসে উঠেছে শোষণের বিরুদ্ধে। আনুশকা যেনো নারীর সে নিপীড়নের দৃশ্য সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে এবং নিপীড়নের ইতি টানতেই এমন সব চিত্রনাট্য বেছে নেন- যাতে ঠুলি পড়া সমাজের চোখটা অন্তত আঙুলের খোঁচায় খোলে। সিনেমা হিসেবে আনুশকার 'বুলবুল' বাজিমাত করলেও হিসেব কষতে হবে সমাজ, নিপীড়িত নারী ও শোষণ মুক্তির পথে এটি কতটা সফল হলো!
ইতোমধ্যে সে হিসেব অনেকেই শুরু করে দিয়েছেন। আমি সে জায়গা থেকে খানিকটা কথা লিখতে বসলাম।
১৮৮১ - বাংলার তৎকালীন সময়ে বাঙলার বাল্য বিয়ে, জমিদারি প্রথা ও জমিদারের অন্দর মহলের কাহিনী ফুটে উঠতে দেখা যায় সিনেমায়। মোটাদাঁগে যদি বলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিত্র 'বুলবুল'। আমাদের গোটা সমাজটাকে সিনেমায় জমিদারের অন্দর মহল হিসেবে দেখান হয়েছে। যেখানে পুতুল নিয়ে খেলার বয়সে বড় ঠাকুরের বউ হয়ে আসে বুলবুল। অন্দর মহলে স্বামী ছাড়া আছেন তথাকথিত পাগল মেজো ঠাকুর মহেন্দ্র, তার স্ত্রী বিনোদিনী, দেওর সত্য। এদের নিয়ে বুলবুলের দ্বিতীয় জীবনের শুরু। অজান্তেই সম-বয়সী সত্যর প্রতি টান জন্মায়। সঙ্গে আষ্টেপিষ্ঠে থাকে এক ডাইনীর গল্প। বয়স বাড়তে বাড়তে একটা সময় সত্যর প্রতি জন্মানো টান প্রেমে পরিণত হয়। একটা সময় স্বামীর নজরে পড়ে দেওর-বৌদির এ প্রেম। অমনি পুরুষতান্ত্রিকতা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। তখনই ভস্মে ঘি ঢেলে তাকে উস্কে দেয়ার মত কাজ করে বিনোদিনীর কান ভারী করা বক্তব্য। ফলে বুলবুলের প্রতি চড়াও হয় স্বামী ; পরিণতি মেরে পা ভেঙে দেয়া! এদিকে মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ হয়ে নেমে আসে তথাকথিত পাগল মেজো ঠাকুরের ধর্ষণ!
এদিকে ঘটনাচক্রে গ্রামের ডাক্তারের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কে সন্দেহের তীরে বিদ্ধ করে প্রেমিক সত্য! পুরুষ! অন্দরের চার দেয়ালে যখন বুলবুলের নিপীড়িত আর্তনাদ ঘুরে ফিরছে তখন ছায়ামূর্তির মত চারপাশটা পৈশাচিক পুরুষের ভয়ঙ্কর থাবা আর রক্ত চক্ষু দেখতে পায়। ফলে নিজেই হয়ে উঠে নিজের রক্ষাকর্তা। ব্যস, এরপর চলে প্রতিবাদী বুলবুলের ঘটনা।
'বুলবুল' সিনেমার একটি দৃশ্যে তৃপ্তি ধিমরি
সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি এক কথায় দুর্দান্ত। কোনো দৃশ্যে মনে হবে না অযাচিত কিছু করা হয়েছে। বরং মুগ্ধ হয়ে সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যে দর্শকের চোখ আঁটকে থাকবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
সিনেমার গল্পকে মাথায় রেখে লাল রঙের ব্যবহার এবং দর্শকদের মাঝে ভয়ের বিষয়টি দেয়ার জন্য নীল রঙ ভিন্ন দৃশ্যপট তৈরী করেছে। আর সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হিসেবে ধরা দিয়েছে অমিত ত্রিবেদীর আবহ সঙ্গীত। একটা গা ছমছম করা পরিবেশ তৈরী করতে তার আবহ সঙ্গীত সফল।
'বুলবুল' সিনেমার একটি দৃশ্যে পাওলি
অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে পাওলি দামের চরিত্র নিয়ে বলতে হবে প্রথমেই। খল-চরিত্রকে দামামা বাজিয়ে যেভাবে আবির্ভূত হতে দেখি সচরাচর- পাওলির চরিত্র এ সিনেমায় তার উল্টো। ফলে পাওলি দামকে দর্শক দেখবে আলাদাভাবে। তৃপ্তি দিমরি সিনেমায় পরিণত চরিত্র সিনেমায় দারুণ সব বাঁক তৈরী করেছে পরতে পরতে। বিশেষ করে তার এক্সপ্রেশন সিনেমায় ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। রাহুল বসু, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অবিনাশ তিওয়ারি প্রত্যেকেই নিজ জায়গা থেকে সেরাটা দিয়ে সিনেমাটিকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। দর্শকের কাছে কেউই বাড়তি অভিনয় করে ধরা খাওয়ার ভুল করেন নি।
হিসেবের শেষে এসে দেখা যায় চিত্রনাট্যের সফলতা এ সিনেমার মূল স্তম্ভ হলেও উপস্থাপন ভঙ্গিমা 'বুলবুল'কে দর্শকের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সফল। এক্ষেত্রে অনভিতা দত্তকে কুর্নিশ। আর বাকিটা রইল আনুশকা শর্মা ও গোটা 'বুলবুল' টিমের প্রতি।



No comments