একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতার মাঝেও নীল গ্রহের প্রতি মুগ্ধতা : গ্র্যাভিটি


কথা বলব ২০১৩ তে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গ্র্যাভিটি’ নিয়ে। পরিচালক আলফনসো কয়ারন। আইএমডিবি রেটিং ৭.৭। রোটেন টমেটো ৯৬%।  সিনেমাতে কি দেখানো হয়েছে সেই কথার থেকে সিনেমাতে কি দেখানো হয়নাই সেই কথাগুলোকেই সবার সামনে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। এর মানে এই না যে সিনেমাতে আরো কি দেখানো যেতো তা নিয়ে রিভিউ লিখতে বসেছি। বরং যা দেখানো হয়েছে সেখান থেকেই কতটা বেশি না দেখানো বিষয়বস্তু চাইলেই দেখে ফেলা সম্ভব সেটাই লিখতে বসেছি।

গ্রাভিটি মুভির প্লট আর সায়েন্টিফিক এক্যুরেসি উইকিতে উঁকি দিলেই পেয়ে যাবেন, তবুও খুব সংক্ষেপে আরেকবার বলছি। চাইলে পরবর্তী এই প্যারাটা স্কিপ করে যেতে পারেন- কারণ এখানে লেখা কথা গুলো আমার লেখার মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। 


ম্যাট কোয়াস্কির কমান্ডে স্পেস শাটার এক্সপ্লেরার যেটা একটা স্পেস মিশনে যায় এবং একটা ধ্বংসাবশেষের সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অচল হয়ে পরে। খুব দ্রুত পৃথিবীতে ফিরে আসা জরুরি হয়ে  পড়লেও ধ্বাংসাবশেষের আঘাতে মিশন কন্ট্রোলের সাথে সব রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

শাটল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরায় রায়ান স্টোনের জীবন রক্ষা হয় আর তার সঙ্গী হয়ে থাকেন ম্যাট কোয়াস্কি কিন্তু দুঃখজনকভাবে আর কোন ক্রুর পক্ষে সার্ভাইভ করা সম্ভব হয় না। যদিও পরবর্তীতে ঘটনাচক্রে রায়ানকে বাঁচাতে ম্যাট নিজের জীবন উৎসর্গ করেন এবং স্টোনকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করান যে যেভাবেই হোক শেনযাউ স্পেসক্রাফটে করে রায়ান যেন সর্বচেষ্টা চালিয়ে অবশ্যই পৃথিবীতে ফেরত যাওয়া নিশ্চিত করে। তারপর একের পর এক উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কিভাবে স্টোন পৃথিবীতে ফেরত আসেন তা দর্শক সিনেমাটি  নিজ থেকে দেখে নিয়েই ভালো উপভোগ করতে পারবেন। 

টিপিকাল সায়েন্স ফিকশন মনে হতে পারে অনেকের কাছে- তাদের আমি দোষ দিব না। কিন্তু আমার কাছে ভিজুয়ালাইজেশন অসাধারণ লেগেছে আর সেই সাথে ঐ যে না দেখানো দুটো উপলব্ধি যা সিনেমাটিকে আমার কাছে টিপিকালের থেকে একটু বেশিই অনুভব করিয়েছে।  এবার উপলব্ধিগুলো নিয়ে কথা বাড়ানো যাক। 

 

এই সিনেমা আমাকে সম্পূর্ণ দুটি বিপরীত কিন্তু সংযোগপুর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে। মানুষ  নামক এই বিশেষ প্রজাতি কখনো এভোল্ভ না করলে স্যার নোয়া হারারির লেখনী অনুযায়ী তাদের ইমাজিনড অর্ডার নামক কোন কিছু্র কখনো অস্তিত্ব থাকত না। আর তা না থাকলে এই বিশাল সভ্যতা কিভাবে গড়ে উঠত আর রায়ান স্টোনকে কখনো ম্যাট কোয়াস্কি কিভাবে বলার সুযোগ পেতো- “You gotta admit one thing- can’t beat the view’’?   কিভাবে পৃথিবী নামক একটা গ্রহ গনগনে লালাভ নক্ষত্রের চারদিক দিয়ে ছুটে যেত কিন্তু কেউ আফসোস করে বলার সুযোগ পেত না- “Beautiful it don’t you think?- the sunrise. That’s what I’m gonna miss the most’’? একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতার মাঝেও নীল গ্রহের প্রতি মুগ্ধতা আর গনগনে আগুনের গোলার উদিত হওয়া- প্রতিদিন দেখে আসার পরও আরও অতিরিক্ত একটা দিন সেই একই দৃশ্য দেখতে চাওয়ার আকুলতা- হোম সাপিয়েন্স ছাড়া আর কার হরমোন এমনতা ঘটতে দিবে?


এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রসঙ্গে- কি হতো যদি হোমো স্যাপিয়েন্সের অস্তিত্ব কখনোই না থাকতো? প্রায় ৫০০ কিমি বায়ুমণ্ডলের নিচের এত কান্না, ক্রোধ, পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ, লিঙ্গ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ব্যাথা, বেদনা, দুঃখ আবার ভালোবাসা, আনন্দ, মুগ্ধতা কি কখনো বিস্তৃত মাধ্যাকর্ষনকে থামিয়ে দিতে পারত? থামিয়ে দিতে পারতো মহাকালকে? এই যে কসোয়াস্কির ত্যাগের মহিমা, রায়ান স্টোনের ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা আর আতঙ্ক- তবুও তো সায়েন্স তার একুরেসি থেকে টলতে একটুও কার্পন্য করেনি, করুনা করেনি। অথচ পদার্থবিজ্ঞানের এই কঠিন বাস্তবতাকে আমরা সহজেই ভুলে যাই। ভুলে যাই মহাকালের ক্যালেন্ডারে আমদের জীবন কত ছোট! আমরা আমাদের বাস্তবতাকে আমল করে একে অপরকে আঘাত করি আবার কখনো ভালোবাসি। আমাদের নিজেদের বাস্তবতা- অর্থ, বিত্ত, সামাজিক মর্যাদা, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধ আমাদেরকে ভুলতে সাহায্য করে যে আমরা কত ছোট, আমাদের অস্তিত্ব কত তুচ্ছ। আমাদের কাল্পনিক নীতিবিন্যাসের বাস্তবতার তোয়াক্কা না করেই সৌরমন্ডলের তৃতীয় গ্রহ সূর্যের চারদিকে প্রতিঘন্টায় ৬৭০০০ মাইল বেগে ঘুরে যায়। তবুও আমরা আমাদের কালেক্টিভ কাল্পনিক নিজস্ব বাস্তবতাকে ভালোবাসি। সিনেমার শেষ দৃশ্যে রায়ান স্টোন যখন নিমজ্জিত পানির মাঝে চারদিকে সবুজ আর উপরে নীল আকাশে পদার্থবিজ্ঞানের বাস্তবতাকে কেবল একটা আলোকরেখার মত ছুটে চলে যেতে দেখে স্বস্তি পায়, ঠিক তেমন স্বস্তি পায় সিনেমার দর্শকেরা- কারণ মোহগ্রস্তের মত ঐ নীল গ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোলাগলেও আমরা আমাদের নিজেদের তৈরি বাস্তবতাকেই বেশি ভালোবাসি; মাধ্যাকর্ষণ বা গ্র‍্যাভিটির অস্তিত্ব থেকেও আমরা আমাদের অস্তিত্বের অনুভবের প্রয়োজনীয়তা বেশি কামনা করি। এটাই অসাধারণ নীল গ্রহের ভিজুয়াইলেশনে তৈরি গ্র‍্যাভিটি সিনেমা দেখার দ্বিতীয় এবং শেষ উপলব্ধি।


লিখেছেনঃ ঐশিক ঐশী

2 comments:

  1. I thought this movie had nothing to offer. But after reading this review I felt like watching it again. Very well thought and observant writing.

    ReplyDelete
  2. Thank you very much for your kind and honest words, Mr. Uzumaki.

    ReplyDelete

Powered by Blogger.