কি এন্ড কা : জায়গা বদলের উপাখ্যান!
মানুষ যখন থেকে সভ্য হতে শুরু করেছে, তখন থেকেই তাদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবার, সমাজ, দায়িত্ব যাবতীয় যা কিছু আছে সবই আমরা ভাগ করে নিয়েছি। যুগে যুগে সেটি হয়ত একটু পরিমার্জিত হয়েছে, কিন্তু নিয়ম হয়ত অনেকটা একই রয়ে গেছে।
ভাগাভাগি করার ক্ষেত্রে একটা কথা বলতেই হয়, এমন না যে আমরা শুধু দায়িত্বকে ভাগ করে নিয়েছি আমরা আসলে দায়িত্বের জায়গাটাকে ভাগ করে নিয়েছি। কে কি করবে কে কি করবে না তা যেন একটা না বলা নিয়মের মত। এমন না যা আমরা জায়গা বদল করতে পারি না, কিন্তু আমরা আমাদের লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ ভেদে আমরা সেই জায়গাগুলোর মধ্যে যেন একটা সীমানা দিয়ে রেখেছি। সেই সীমানাকে চ্যালেঞ্জ করতেই ২০১৬ সালে ভারতে মুক্তি পেয়েছিল কি এন্ড কা। আপাত দৃষ্টিতে রম-কম জনরার বলে মনে হলেও সিনেমাটিতে ছোট ছোট কিছু ঘটনার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যকার সামাজিক দ্বন্দ্ব বা দায়িত্বের জায়গাটিকে খুব বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকে নারী যেন শুধু ঘর সামলাবে, পুরুষ শুধু বাহির সামলাবে ধারণা চলে এসেছে, বর্তমান যুগকে পোস্ট ফেমিনিজম যুগ বলা হলেও ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে নারীকেই যেন প্রত্যাশা করা হয়।
কিন্তু, ছবির গল্পের মূল চরিত্র কিয়া এবং কবির যেন ঠিক তার উল্টো; এই গৎবাধা ধারণা একদমই নেই তাদের মধ্যে। কিয়া একটি ফার্মের মার্কেটিং ম্যানেজার, সে গৃহিণী হয়ে থাকতেই চায় না, বিয়ে জিনিসটা তার কাছে গলায় ফাসের মত লাগে। অন্যদিকে, কবির একেবারেই ক্যারিয়ার, চাকরী নিয়ে ভাবতে চায় না, তার কাছে ব্যবসা মানে রবোটিক কাজ-কারবার। এরকম দুটি মানুষের হঠাৎ করেই এক ফ্লাইটে দেখা হয়ে যায়। কিছুদিন দেখা-সাক্ষাতের পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা বিয়ে করবে। কিন্তু, শর্ত হচ্ছে কবির ঘর সামলাবে আর কিয়া নিজের চাকরী। মানে তারা সমাজের প্রচলিত নিয়ম থেকে বের হয়ে নিজেদের পছন্দমত জীবন যাপন করবে।
যেই কথা সেই কাজ, কিন্তু জীবন কি এতই সোজা?
এই প্রশ্নের থেকেও বড় প্রশ্ন হল মানুষ কি এতই সোজা? উত্তর হবে না; মানুষ এত সোজা না! কিয়া এবং কবির এর বিয়ের পরই মূলত গল্পের শুরু। এই বিয়েতে নারী-পুরুষদের দায়িত্বের আদান-প্রদান হয় ঠিকই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্বটাও ঠিক একইভাবে এসে যায়। কিন্তু কেন? তারা তো দায়িত্ব ভাগাভাগি করেই নিল, তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সেই সমস্যার সূচনা কিংবা উপসংহার যাই বলি না কেন সবই এই সিনেমাতে দেখানো হয়েছে।
সমস্যা নারী অথবা পুরুষ নয়, সমস্যাটা যে ঠিক কি তা আপনি সিনেমা সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অনুধাবন করতে পারবেন। একটা সম্পর্কের ভিতর ইগো কিভাবে তৈরী হয়, ভুল বোঝাটার শুরু ঠিক কোত্থেকে এই ছোট ছোট বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক।
অনন্য এই গল্পের জন্য মূল পাত্র-পাত্রী একদম পারফেক্ট হওয়া ছিল এই ছবির প্রধান দাবি। আমার মতে সেদিক থেকে কারিনা কাপুর আর অর্জুন কাপুর বেশ ভালভাবেই উতরে গেছেন। কিয়া চরিত্রে কারিনা একদমই সাবলীল ছিলেন, একজন স্বাবলম্বী নারী হিসেবে কিয়া যেরকম কনফিডেন্ট আর পূর্নাংগ হওয়ার কথা; কারিনা তার সবটাই দেখাতে পেরেছেন। সত্যি কথা বলতে আমাদের সমাজে নারী স্বাবলম্বী যতই হোক, ঘরজামাই পুরুষ কখনোই কোন নারী বিয়ে করতে চাবে না। সেদিক থেকে কিয়া তার ঘরজামাই স্বামীর ব্যাপারে কতটা উদার সেটাও কারিনা তার অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। সত্যি কথা বলতে কবির চরিত্রে অর্জুন আমাকে বেশ অবাক করেছে। একজন পুরুষ যার ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে কোন তাগিদ নেই, সে অল্পের মধ্যেই সুখী থাকতে চায়। সে কি করতে চায় জানতে চাইলে সে গর্বের সাথে বলে আমি আমার মায়ের মত গৃহিণী হতে চাই। এরকম একটা চরিত্রের জন্য অর্জুন কাপুরের থেকে ভাল আর কেউ হতে পারত কি না তা আমি বলতে পারব না। কবিরের সঙ্গে তিনি নিজেকে একদম মানিয়ে নিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, পুরুষও যে নারীর মত ঘর সামলাতে পারে তা অর্জুন কাপুর ভাল মত ফুটিয়ে তুলেছেন।
ছবির দুর্বল দিক যদি বলতে হয় তাহলে আমি বলবো এরকম একটি দম্পতিকে ঘিরে যে ধরনের সমস্যা সাধারণত হয়ে থাকে, ডিরেক্টর আর বালকি তার সবটা তুলে ধরেননি। তিনি শুধু নারী পুরুষ দ্বন্দ্বের মূল জায়গাটিকেই পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। ছবির দৈর্ঘ্য যাতে বেশি না বাড়ে সে কারণেই কি না সেটি ডিরেক্টরই ভাল বলতে পারবেন।
ছবির বক্স অফিস কালেকশন বা আইএমডিবি রেটিং দেখে আপনি ছবিটিকে ইগ্নোর করতেই পারেন, কিন্তু আপনি যদি আসলেই ভিন্ন ধারার ছবি দেখতে চান তাহলে কি এন্ড কা আপনার লিস্টে থাকতেই পারে।
লিখেছেনঃ এসবি মেরাজ
No comments