আরে, এ তো আমাদেরই কথা! আহা!
আহা! চলচ্চিত্রের অফিশিয়াল পোস্টার
আহা! (২০০৭)
চলচ্চিত্রের নামে যতটা না মাধুর্য, গোটা চলচ্চিত্রে তার দ্বিগুণ মাধুরী মেশানো। হ্যা বলছিলাম আহার কথা। নামটা শুনেই জানতে ইচ্ছে করে কি আছে এই ছবিতে? কাদের গল্প বলা আছে? আহা! কেন নামকরণ হলো? আমরা ত কারো খুব অসহায় পরিস্থিতিতে, কারো জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে গেলে বা কেউ করুণ নিয়তির মুখোমুখি হলে মনের অজান্তে অস্ফুটে বলে উঠি " আহা!"
এই ছবিতে তবে কি কেউ এমন অসহায়? কেউ মুখোমুখি তার অমোঘ নিয়তির?
সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে৷ প্রথমে পরিচালককে বাহবা দিতে হয় ঢাকার ঐতিহ্যের দিকে এক কাব্যিক ভাবে আলোকপাত করার জন্যে। আমদের চলচ্চিত্রে ঢাকা এমন ভাবে শেষ কবে উপস্থাপিত হয়েছিলো আমার মনে পড়ে না। "ঢাকাইয়া মাস্তান" জাতীয় চলচ্চিত্রে ঢাকা শহরের মাস্তান নির্মানের কারিগর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, ঢাকাকে সংঘাতের শহর, দারিদ্রের শহর আর কান্নার শহর হিসেবে উপস্থাপনেই যেনো নির্মাতারা স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন।
'আহা! ' এ সমস্ত কিছুকে ভেঙে দিলো।
পুরান ঢাকার নান্দনিক সত্তাকে এই চলচ্চিত্রে নতুন ভাবে আবিষ্কার করা হলো। আমরা আসলেই কি ভুলে যাই আমাদের সম্পদ কতভাবে এখন ও আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে? পুরান ঢাকায় পুরাতন এমন অনেক বাড়ি আছে যেগুলোর গড়ন,আর্কিটাকচারাল কাঠামো শুধু যে ভিন্ন রকম তা নয় ভীষণ মাত্রার শৈল্পিক।
এই চলচ্চিত্রের পরিচালক তার গল্পের প্রধান চরিত্র দের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছেন তেমনই এক শৈল্পিক বাড়িতে। হ্যা, নগরীর কোন অভিজাত স্থানের ডুপ্লেক্স বাড়ি নয়, পুরান ঢাকার গলি ঘুপচির ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক আদিম সংস্কারহীন বাড়ি। যে বাড়ির কার্নিশে কার্নিশে কবিতা, বারান্দায় সুখের আঘ্রাণ। বাড়ির মালিক তার এই বাড়ি ডেভেলপারদের হাতে সঁপে দিচ্ছেন, বাড়ির সংস্কার হবে, আধুনিক ফ্ল্যাট নির্মান হবে। তার মেয়ে (রুবা) দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরে এসে নতুন করে প্রাণ খুঁজে পাচ্ছে নিজের মাঝে। রুবার মাধ্যমেই আমরা বাড়িটার সাথে আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হই। বাড়ির প্রত্যেক টা কোণে রুবা তার ছেলেবেলার গন্ধ পায়। রুবা বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। শুধু মাত্র ঘুরে বেড়ায় তা না, সে যেনো বাড়ির প্রত্যেকটা কোণের সাথে কথা বলে, বাড়ির প্রত্যকে জানালা তার কথায় যেনো সাড়া দেয়।
পুরান ঢাকার প্রাচীন বাড়ি গুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাদের প্রশস্ত জানালা গুলো। সেই জানালা দিয়ে ঘরে কেবল আলো হাওয়া না এমন একটা শুভ বার্তা প্রবেশ করে এতে মনের বিষণ্ণতা কেটে যায়, ঘোর লাগে। যেমনটা ঘটছিলো রুবার ক্ষেত্রে। মনের গভীর ক্ষত গুলি জানালায় উড়ে আসা প্রশস্তিতে ঢাকা পড়ছিলো তার।
বাইরে তাকিয়ে আকাশ জুড়ে ঘুড়ির আনাগোনা চোখে পড়তে হয়তো তার মনে বাজছিলো "মন চায় উড়তে উড়তে"। আহা...
বাড়ির দিকে ডেভেলপারের নজর, রুবার এতে ভীষণ আপত্তি।তার বাবা যদিও সমস্ত ঐতিহ্যকে পিষে নতুন দালান তৈরির দিকেই মনোযোগী।
পুরান ঢাকার 'বর্ষা' ও দারুণ শৈলীতে উপস্থাপন করেছেন নির্মাতা। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টিতে পুরান ঢাকার গলিতে মানুষের ছোটাছুটি, ছাতা হাতে নিরাপদ আশ্রয়ে দৌড়ে যাওয়া, বিদ্যুতের তারে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জলকণা আর পাড়ার ছেলেদের খালিগায়ে ঝুম বৃষ্টিতে ফুটবল খেলা... আহা! আর সবশেষ আমরা যখন রুবাকে শাড়ি পরে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখি তখন ঢাকার বর্ষার উপস্থাপন যেনো পূর্ণতা পায়। না শাড়ি পরে বৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কোন ছন্দহীন কথার গানে নাচছিলো না রুবা, আর দশটা বাঙালি মেয়ে যেমন করে শাড়ি পরে বর্ষাযাপন করে রুবা ঠিক তাই করছিলো, বর্ষার উপস্থাপন যে এমন সাবলীল ভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও হয়, তা ত প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম।
পরিচালক ঢাকা কে উপস্থাপন করবেন আর সেখানে বুড়িগঙ্গার কথা থাকবে না তা কি করে সম্ভব। রুবার এরই মাঝে এক প্রতিবেশীর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। কিসলু নামের সে ভদ্রলোক রুবাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী দেখেন। তাদের কথপোকথন এর কিছু অংশ এরকম-
কিসলু - এই নদীটার নাম জানেন তো?
রুবা - বুড়িগঙ্গা
কিসলু - কি অদ্ভুত না এই নদীটার কোন শৈশব নেই, কোন কৈশোর নেই, কোন তারুণ্য নেই তারপরেও এটার নাম বুড়িগঙ্গা, ভারী অদ্ভুত। ইস, পানিটা কত ময়লা দেখেছেন?
রুবা- খুব ময়লা...
বুড়িগঙ্গা নদীর নাম নিয়ে কিসলুর পর্যবেক্ষণ আর নদীর পানির এই বেহাল দশা নিয়ে আক্ষেপ এর সাথে আমরা যারা ঢাকায় থাকি, কখনো এই নদীর কাছে গেছি প্রত্যেকের পর্যবেক্ষণ ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে মিলে যায়। সাধারণ দর্শকের মনে হয় আরে, এ তো আমারই কথা।আহা!
ঢাকার আরো একটি ঐতিহ্যবাহী স্থানে আমরা আবিষ্কার করি রুবা আর তার নব্য বন্ধুটিকে। সেই স্থান সম্পর্কে রুবার অজ্ঞতায় তার বন্ধুটি বলে উঠে -"হায়রে বাঙালি, নিজের গৌরবের ব্যাপারটাও ভুলে বসে আছেন।" এই একটা মাত্র সংলাপ আমাদের সমস্ত ভুলে যাওয়া গুলি চোখের সামনে এনে দেয় নাকি? জাতিগতভাবেই বর্তমান আমরা আমাদের আদর্শ, ইতিহাস, গৌরব সবকিছু সম্পর্কে অতিমাত্রায় উদাসীনতায় ভুগী। বিশেষ দিন গুলোয় মেয়েরা শাড়ি আর পুরুষেরা পাঞ্জাবী পরে রাস্তার পাশে ফুচকা খেয়ে আর বেলুন উড়িয়ে কাটিয়ে দেই। জানার প্রয়োজন ও বোধ করি না আসলে বিশেষ দিনটা "বিশেষ" কি কারণে হলো?
এর পেছনের ইতিহাস কি? কিসলুর এই আক্ষেপ কেবল মাত্র রুবার অজ্ঞতার জন্যে নয়৷ লাখো লাখো বাঙালির জন্যে যারা নিজেদের গৌরব গাঁথা শাড়ি পাঞ্জাবী পরিধান আর সেলফি তোলায় চাপা দিয়েছেন সময়ের সাথে সাথে। আহা!
রুবার সাথে এই ব্যক্তিটির সখ্যতা রুবার বাবার মেনে নিতে কষ্ট হয়। একসময় তিনি তাদের বাড়ি ভাঙার কাজটা শুরু করার তাগিদে এই জীর্ণ বাড়িখানা ছেড়েও চলে যান তার মেয়ে, নাতি আর কাজের লোকেদের নিয়ে।
রুবার বাবা একজন ভদ্র, নির্ভেজাল মানুষ।তাঁর মনে যে মায়া- দয়া নেই তাও না। তিনি খুনী জেনেও এক লোককে তাঁর বাড়িতে কাজে নিয়োগ দেন। কেবল মাত্র নিজের মেয়ের এই অবেলায় গড়ে উঠা বন্ধুত্বে তিনি সায় দিতে পারেন নি। যদি তিনি বুঝতেন হয়তো এই গল্প রুবার বর্ষা যাপনের মতোন স্নিগ্ধ কোন পরিনতির দিকে এগিয়ে যেতো। কিন্তু মানুষ বড়ই অদ্ভুত। যা স্বাভাবিকভাবে হয় তাতেই হঠাৎ বড় রকমের আপত্তি চলে আসে তার মনে। আর রুবাদের গল্পগুলো এমন অপূর্ণ থেকে যায়। আহা!
এই ছবিতে একটা বাড়ির গল্পএকজন নারীর গল্প মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে...এর মাঝেই আমরা কিছু বিনোদন খুঁজে নেই! আহা!
© পরমা সোম

No comments