হুইপ্ল্যাশঃ টেম্পো না ধরলে ধরা!

 


মিউজিক! যেহেতু ইংরেজি সিনেমা নিয়ে কথা বলবো তাই সঙ্গীত শব্দটি না বলে মিউজিকই ব্যবহার করছি। ২০১৪ সালে দেখা একটা সিনেমা নিয়ে কি মনে করে আজ লেখতে বসলাম নিজেও জানি না, না ভুল বললাম আসলে জানি। কিন্তু সেই জানাটা কিভাবে জানলাম তাই আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো। 

প্রথমত, এই মিউজিক শোনার জন্যই সিনেমাটি দেখা। কলেজের এক বন্ধু বলেছিল এই সিনেমাটি অনেক ভাল, মিউজিকগুলো জোস! তাই সেই জোস মিউজিক শোনার জন্যই এক প্রকার জোর করেই দেখতে বসা। আগেই বলে রাখি জ্যাজ মিউজিক সম্বন্ধে আমার তখন কোন ধারণাই ছিল না। বন্ধুর অনুরোধে ঢেকি গিলতে গিয়ে সিনেমাটি দেখতে বসা এবং মিউজিক শোনা দুটিই করা হলেও সত্যি বলতে সিনেমা তখন তেমন একটা মাথায় ধরে নি, ধরে নি বলতে অনুভব করতে পারিনি। তাই অনেক অপরিচিত সিনেমার মত এটাও এক প্রকার ভুলে গিয়েছিলাম। সিনেমার নামটা বলছিনা কারণ ২০১৪ সালে দেখাটা না দেখার মতই ছিল। খালি মনে আছে ছবিটা পাঁচটি বিভাগে অস্কার পেয়েছিল, অস্থির মুভি, অসাধারণ মুভি,নাইস, জোস ওয়াও ব্যাস এই পর্যন্তই! তবে হ্যা তাতে একটা উপকার হলো জ্যাজ মিউজিক সম্পর্কে অল্প স্বল্প ধারণা পেলাম। খারাপ লাগেনি এতটা, ভালই লেগেছিল। কিন্তু ওই যে বললাম সিনেমাটা না দেখার মত দেখার কারণে আস্তে আস্তে সেটাও ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু, সেই না দেখার স্মৃতি আবার প্রকট হতে শুরু করলো ২০১৭ সালে। তখন আমি কেবল শিল্পকলার মঞ্চে ওঠা শুরু করেছি। আমার প্রথম মঞ্চ নাটকের রিহার্সাল হচ্ছিল তখন। সেটাও একটা মিউজিকাল ড্রামা ছিল। রিহার্সালে তাল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, সূক্ষ হতে সূক্ষতর তাল নিয়ে ব্যাপক তর্কে মেতে গিয়েছিলেন সিনিয়রেরা। আমি এসব বিষয়ে গন্ডমূর্খ তাই শুনে যাচ্ছিলাম, কিছু মাথায় ঢুকছিল, কিছু ঢুকছিল ন। তখনই আসল ক্যারাভান এর কথা, ক্যারাভান সুর তোলা যে কতটা কঠিন সেটা নিয়ে কথা হওয়ার সময়ে একটু কান খাড়া হয়ে গেল আমার। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কি জ্যাজ মিউজিক নিয়ে কথা বলছেন? জবাব আসল হ্যা! আমার তখনই মনে পড়ল ২০১৪ সালের সেই সিনেমার কথা। সেই সিনেমাতেই এই ক্যারাভান শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম। জ্যাজ মিউজিকের অন্যতম কঠিন সুরের নাম এই ক্যারাভান। জুয়ান টিজলডিউক এলিংটনের করা এই বিরল কাজ যেন সকল জ্যাজপ্রেমীদের মাথায় থাকবে চিরকাল। সেই সূক্ষ কাজ নিয়ে কথা বলতে বলতেই আলোচনা চলে গেল হুইপ্ল্যাশ সিনেমাতে, ক্যারাভান সুরকে কত সুন্দর করে সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে সেটি নিয়ে সবার মুখে শত শত প্রশংসা! মজার ব্যাপার হচ্ছে সবাই সেই সিনেমা নিয়ে কথা বলছে যে সিনেমাকে আমি ২০১৪ সালে দেখে ভুলেও গেছি! সিরিয়াসলি? সবাই এটা নিয়ে কত কথা বলছে আর আমি দেখেও কিছু বলতে পারছি না কারণ আমি শুধু সিনেমাটি দেখেছি, অনুধাবন করিনি। অনুধাবন করার জন্য হোক, বা সবার সামনে লজ্জা পাওয়ার কারণেই হোক পরের দিনই আমি আবার দেখতে বসলাম হুইপ্ল্যাশ! না এবার সিনেমার নাম ভাল করেই মাথায় রেখেছিলাম। না হলে আবার আগের মত ধরা খাব কি না। কি ছিল সিনেমার মধ্যে? এই প্রশ্নটা সব সিনেমার জন্য আগে থেকে সাজানো থাকে। আমি বলবো, আপনি যদি নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পথে নেমে থাকেন; তাহলে আপনি বলবেন কি নেই এই সিনেমার মধ্যে। মিউজিক একটি কঠিন সাধনা এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু এই সাধনার শেষ কোথায়! কোথায় গেলে আমরা বুঝতে পারবো এই সাধনা আমরা সম্পূর্ণ করেছি? পরিপূর্ণতা এসেছে কি না তা বুঝবো কি করে? সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতেই এন্ড্রিউ নিম্যান নামক এক তরুণ চলে আসে শ্যাফার কনসারভেটরি নামক মিউজিক স্কুলে যা নিউ ইয়র্কের অন্যতম প্রসিদ্ধ মিউজিক স্কুল (এমন কোন স্কুল বাস্তবে নেই, সিনেমার শুটিং হয়েছে নিউ ইয়র্কের জুলিয়ার্ড স্কুলে।) ড্রামার হিসেবে কাজ করার তার মধ্যে রয়েছে অদম্য ইচ্ছা, কিন্তু সেই ইচ্ছার মধ্যে পানি ঢেলে দিতে কিনা কে জানে! শ্যাফারে আর সঙ্গে দেখা হয় ফ্লেচার নামক খুব কাঠখোট্টা শিক্ষকের। তাকে প্রচন্ড ভয় পায় শ্যাফারের শিক্ষার্থীরা। সঙ্গত কারণে এন্ড্রিউ তার সামনে খুব সহজ হতে পারে না। তার প্রভাব পড়তে থাকে তার সাধনায়। ফ্লেচার বারবার বলে “তুমি আমার টেম্পো ধরতে পারছো না!” এন্ড্রিউ বুঝতে পারেনা ঠিক কোন টেম্পো সে চাচ্ছে? ওই যে বললাম ঠিক কতটুকু গেলে সাধনা তার পরিপূর্ণ হবে সে বুঝে না! কারণ সে যতই করে ফ্লেচারের কাছে সেটা ততই কম মনে হয়। তাহলে এই টেম্পোর শেষ কোথায়? কিসে আসবে পরিপূর্ণতা বা পারফেকশন! এই পারফেকশন খোজার মনস্তাত্বিক যাত্রাকে ঘিরেই হুইপ্ল্যাশ সিনেমার গল্প তৈরী! এখন বলতেই পারি জ্যাজ মিউজিক পছন্দ হলে দেখে ফেলতে পারেন সিনেমাটি। না জ্যাজ মিউজিক বিষয় না; বিষয় হল আপনি কখন জানবেন আপনার সীমা কতটুকু। শিল্পের এই দুনিয়ায় পারফেকশনের লেভেল কোন জায়গা থেকে টেনে দেওয়া হয়েছে বা আদৌ কোন লেভেল আছে কিনা সেটা যদি আপনি বুঝতে চান, এই সিনেমা আপনার জন্য! সাথে ক্যারাভান, হুইপ্ল্যাশ সুরের অসাধারণ সুরগুলো তো রয়েছেই। মজার বিষয় হচ্ছে এখানে আপনি প্রতিনয়ত মূল চরিত্র এন্ড্রিউ আর ফ্লেচারের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকবেন, প্রতিনিয়ত আপনি এদেরকে বোঝার চেষ্টা করবেন আর হারিয়ে যেতে থাকবেন মিউজিকের উন্মাদনায়! এদের মধ্যকার মনস্তত্বের টেম্পো আপনি যদি ধরতে পারেন, ক্লাইম্যাক্স আপনি খুব ভালভাবে উপভোগ করতে পারবেন। ক্লাইম্যাক্সের ক্যারাভান সুর আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারবে সাধনা কাকে বলে আর সাধনার লেভেল ঠিক কতটুকু। পাঁচটি বিভাগে অস্কার পাওয়া ছাড়াও এই সিনেমা সানডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা সিনেমার পুরস্কারও বাগিয়ে নেয়। 

পরিশেষে, এইটুকু বলতে পারি সিনেমা যদি উপলব্ধি না হয় তাহলে সেই সিনেমা আমার কাছে সিনেমা নয়। হুইপ্ল্যাশ নামক মিউজিকের এই অপরূপ উপলব্ধি ধারণ করতে চাইলে সিনেমাটি এখনই দেখা শুরু করতে পারেন।

 লিখেছেনঃ এসবি মেরাজ

No comments

Powered by Blogger.