মিনাক্ষী সুন্দরেশ্বর: সম্পর্কের বন্দনা!

 

 

আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয়, সম্পর্ক একটি গাছের মত। একে ভাল রাখতে হলে নিয়মিত পানি দিতে হয়, রোদে রাখতে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে দিতে হয়। নাহলে সেই সম্পর্ক আস্তে আস্তে নির্জীব গাছের মত হয়ে যায়। এই ভাবনা আরো জোরাল হল যখন নেটফ্লিক্সের সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া সিনেমা মিনাক্ষী সুন্দরেশ্বর দেখলাম। মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে এটিকে নিয়ে যেমন ইতিবাচক মন্তব্য শোনা যাচ্ছিল, তেমনি নেতিবাচক মন্তব্যের সংখ্যাও খুব কম আসছিল না। সমালোচনা আসছিল গল্পের দিক থেকেই বেশী পরিমাণে। মানুষের রিভিউ পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল এতটাই কি বাজে হয়েছে এই সিনেমার গল্প? কয়েকজনকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম এই সিনেমার গল্প খুবই মিডিওকোর। আজকাল এই শব্দটা খুব বেশি ট্রেন্ডিং। কোন কিছু তেমন ভাল না লাগলেই মিডিওকোর শব্দটা তার সাথে জুড়ে দেয়া হয়। যে সিনেমা নিয়ে মিশ্র অনুভূতি দেখা যায়, সেই সিনেমার প্রতি কৌতূহল বেশি থাকে আমার। সেই জন্যই গতকাল দেখতে বসলাম মিনাক্ষী সুন্দরেশ্বর। ঠিক দেখতে নয়, জানতে ইচ্ছে হল এই ছবি ঠিক কতটা মিডিওকোর! 

প্রথমেই বলে রাখি সিনেমা দেখার ব্যাপারে আমি খুব বেশি বাছাই করতে পছন্দ করি। সব ধরনের সিনেমা আমি ঠিক দেখিনা আবার সব ধরনের সিনেমা দেখার চেষ্টা করি; বিশেষ করে নবাগত অভিনেতা অভিনেত্রীদের। তার পেছনেও কারণ আছে, নতুনদের ভেতর ভাল কাজ করার একটা স্পৃহা থাকে। পর্দায় নিজেদের প্রমাণ করার একটা অদম্য শক্তি কাজ করে তাদের মধ্যে। সবার মধ্যে যে এই ব্যাপারটা আছে তা নয়, কিন্তু কিছু মানুষদের মধ্যে এই ব্যাপারটা যেন প্রবলভাবে থাকে। এই সিনেমার মূল পাত্র-পাত্রী সানিয়া মালহোত্রা এবং অভিমন্যু দাসানীর ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। বিশেষ করে সানিয়া মালহোত্রা! দঙ্গল, পটাকা, লুডো কিংবা পাগ্লেট এর মত সিনেমায় অভিনয় করা সানিয়া দর্শকদের ঠিক বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি রিয়েল লাইফ চরিত্রগুলোকে কত সুন্দরভাবে পর্দায় তুলতে পারেন। মিনাক্ষী সুন্দরেশ্বরের ট্রেইলারটা দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম এটা দেখতে হবে। 

পরীক্ষার মধ্যে দেখার সাহস না করাতে দেখতে একটু দেরী করে ফেলেছিলাম, কিন্তু যাই হোক শেষমেশ দেখে ফেললাম। প্রথমেই বলেছিলাম এই ছবির গল্প ঠিক কতটা মিডিওকোর সেটা জানার আমার একটা আগ্রহ ছিল। কিন্তু তার আগে আমি কথা বলতে চাই গল্প ছাড়া এই সিনেমার অন্যান্য উপাদান নিয়ে। প্রথমেই আসি সিনেমার ডায়লগ। ডায়লগ নিয়ে না বললে আসলে খুব কমই হয়ে যাবে। এই সিনেমার প্রত্যেকটি ডায়লগে যেন জাদু ছিল, সেই জাদু অদৃশ্য জিনিসকে দৃশ্যমান করে না। কিন্তু কিছু অব্যক্ত কথাগুলোকে ঠিকই বের করে আনে। আপনি হয়ত সংলাপগুলো শুনে হঠাৎ করেই নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতে শুরু করবেন। একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতে চাইবেন, মিনাক্ষী আর সুন্দরেশ্বরের মধ্যকার কথোপকথন আপনার মধ্যে একটি হাহাকার তৈরী করলেও করতে পারে। ডায়লগই যেন এই সিনেমার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র ছিল। তারপরই আসতে হবে অভিনয়ে, আমি আগেই বলেছিলাম নতুনদের কাজের ব্যাপারে আমার আগ্রহটা থাকে বেশী কারণ তাদের মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করার একটা স্পৃহা থাকে। অভিমন্যু আর সানিয়া দুজনেই আমাদেরকে সেখান থেকে একদমই হতাশ করেনি। সানিয়া তো ভাল কাজ করেছেনই, অভিমন্যুর প্রথম ছবি মার্দ কো দার্দ নেহি হোতা’র ইউনিক আর প্রশংসনীয় অভিনয়ের পর তিনি আর কি নতুন দেখাবেন সেটাই দেখার অপেক্ষা ছিল। বাজিমাত না করলেও তিনি যে পর্দায় নিজের চরিত্র সুন্দরকে সুন্দরভাবেই উপস্থাপন করতে পেরেছেন তাতে কোনই সন্দেহ নেই। সুন্দর একজন লাজুক প্রকৃতির মানুষ। স্ত্রীকে ভালবাসলেও সে ঠিক জানে না সেই ভালবাসার চর্চাটা কিভাবে ধরে রাখতে হয়। তার মিনাক্ষীকে ভালবাসার চেষ্টা, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা, নিজেকে সব কিছুর সাথে মিশিয়ে নেওয়ার নির্লিপ্ত চেষ্টা প্রত্যেকটি অংশই অভিমন্যু নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। বাজিমাত শব্দটা অভিমন্যুর সাথে না গেলেও সানিয়ার সাথে যাবেই যাবে। মিনাক্ষী একজন চুপচাপ স্বভাবের কিন্তু সে তার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ভীষণ রকম সচেতন। সে অনেকটা পানির মত। সব কিছুর সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিতে পারে। সে সিনেমা হলে রজনীকান্তের সিনেমা দেখে নাচতেও পারে আবার চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে কনফিডেন্সের সাথে উত্তরও দিতে পারে। তার মধ্যে সুন্দর নিয়ে ফ্যান্টাসী, তার জন্য অপেক্ষা সবই আছে। সে সুন্দরকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে কিন্তু নিজেকে ছোট করে নয়। এরকম নরম আর শক্তিশালীর মিশেলে তৈরী একটি চরিত্রতে সানিয়া নিজেকে এত সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছেন তা সিনেমা না দেখলে আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। 

সবশেষে আসি গল্পের কথায়, না এত বড় করে লেখার কিছু নেই এই গল্প নিয়ে। প্রথমেই বলেছিলাম সম্পর্ক একটি গাছের মত। একে নিয়মিত পরিচর্যা না করলে সেটি নির্জীব হয়ে যাবে। সুন্দরেশ্বর আর মিনাক্ষীর গল্পটাও ঠিক তেমনি। তাদের সম্পর্ক মাঝে মাঝে রোদে উজ্জ্বল হতে গিয়েও বৃষ্টির ভারে হঠাৎ মিইয়ে যায়। কিন্তু যত ঝড়-ঝাপ্টা আসুক না কেন, আস্তে আস্তে তারা ঠিকই পরিচর্যা করাটা শিখে নেয়।

এই সিনেমা কোন গল্প নয়, এটি আসলে একটি উৎসব। বিবাহিত জীবনের কিছু সুন্দর সুন্দর মুহুর্তের উৎসব। এই উৎসবে কিছু সুন্দর সুন্দর গান আছে, চোখের পানি আছে, ঝগড়া আছে, ভালবাসা আছে, জীবনকে নতুন করে উপভোগ করার বন্দনা আছে। আর তার মধ্যেই মিনাক্ষী সুন্দরেশ্বর গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এটা ঠিক শেষ বলবো না আমি, কিছু গল্প কখনো শেষ হয় না। কারণ সম্পর্কের বন্দনা কি কখনো শেষ করা সম্ভব?


লিখেছেনঃ এসবি মেরাজ



No comments

Powered by Blogger.