বব বিশ্বাস ও বেচারা অভিষেক বচ্চন!

 

 

“নমস্কার,বব বিশ্বাস! এক মিনিট!” এই লাইনের পরে কি হত সেটা প্রতিটি সিনেমাপ্রেমী মানুষই বলতে পারবেন। ২০১২ সালে নির্মিত কাহানি ছবির সিরিয়াল কিলার বব বিশ্বাস এতটাই মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল যে কেউ ববকে এখনো ভুলতে পারেনি। থ্রীলার জগতে বব বিশ্বাস যেন একটি ভয়ংকর সুন্দর চরিত্র! একটি চরিত্র তখনই সুন্দর হয় যখন সেটিকে সুন্দর করে রূপায়ণ করা হয়। বাঙালি অভিনেতা শাশ্বত চ্যাটার্জী বব বিশ্বাসকে এত সুন্দর করে তুলে ধরেছিলেন যে দর্শক একজন সিরিয়াল কিলারের ভক্ত হয়ে পড়েছে। সেই আগ্রহ আরও চরম মাত্রায় চলে যায় যখন ঘোষণা হয় যে বব বিশ্বাস নিয়ে একটি সিনেমা বানানো হবে। 

তবে সেই আশায় অনেকটা ভাটা পড়ে যায় যখন শাশ্বত নিজেই এই চরিত্রটি আরেকবার করতে মানা করে দিলেন। তাহলে কে হবে বব বিশ্বাস? অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে জানা গেল অভিষেক বচ্চন হতে যাচ্ছেন বব বিশ্বাস! তাহলে বব বিশ্বাস হিসেবে অভিষেক কেমন করবেন সেটাই ছিল আলোচনার মূলবস্তু, সম্প্রতি জিফাইভে বব বিশ্বাস মুক্তিও পেয়ে গেছে। তাহলে কেমন করলেন অভিষেক বচ্চন? চলুন জেনে আসি। 

প্রথমেই আমি ফেসবুকে দেখা কিছু দর্শকদের মতামত নিয়ে আলোচনা করবো। তারপরই আমার কেমন লেগেছে সেটি নিয়ে কথা বলবো। আগেই বলেছি বব বিশ্বাস হিসেবে যখন অভিষেক বচ্চনের নাম চলে আসে, তখন সবাই সেটা নিয়ে কম বেশি হতাশ হয়েছে। শাশ্বতের আইকনিক উপস্থিতির জায়গায় অভিষেককে কল্পনা করাটা আসলেই একটু কঠিন। ট্রেইলার মুক্তির পর সেই জায়গাটা আরও জোরাল হয়ে ওঠে। কারো কাছে গেটআপ সুন্দর হয়নি, কারো কাছে অভিষেকের এক্সপ্রেশন ভাল লাগছে না, ডায়লগ পিচ সুন্দর হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে খেয়াল করলাম প্রত্যেকের জায়গায়ই একটি কথাই খুব কমন যে শাশ্বতের মত হয়নি। এরপর গল্পের জায়গা থেকে দেখলে জানা যায় যে গল্প খুবই সাধারণ ছিল, এরকম সাধারণ গল্পে বব বিশ্বাসকে আনাটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি, কোলকাতার চির পরিচিত লোকেশনে বব বিশ্বাসকে ঠিক সুন্দর করে রূপায়ণ করা হয়নি, গল্পে অনেক ঘাটতি ছিল ব্লা ব্লা ব্লা! এরপর ইউটিউবে এবশ কিছু রিভিউ দেখতে গিয়ে একটা জিনিস খেয়াল করলাম সেখানেও অভিষেকের অভিনয়কে শাশ্বতের অভিনয়ের সাথে তুলনায় নিয়ে যাচ্ছে। মোট কথা দর্শকের জায়গা থেকে বললে বব বিশ্বাস খুবই মিডিওকোর একটি সিনেমা। যদিও একে নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্যও হয়েছে; পুরোপুরি নেতিবাচকে ভরে যায়নি বব বিশ্বাস। তারপরও সমালোচনার ঝুলিটাই যেন বেশী! তাহলে কি অভিষেক বব বিশ্বাস হিসেবে ব্যর্থ হলেন? সেটি জানতেই ৩ ডিসেম্বরে মুক্তি পাওয়া বব বিশ্বাস দেখে ফেললাম। দেখে আমার অভিষেক বচ্চনের প্রতি এক প্রকার কষ্টই হল। বেচারা এত জীবন্ত অভিনয় দেখানোর পরও তাকে নিয়ে এত সমালোচনা কিভাবে হয় সেটাই আমার মাথায় আসেনি। তবে দর্শকের সমালোচনা দেখার পর সেটা নিয়ে কিছুটা ধারণা পেলাম। প্রথমে যদি অভিনয়ের কথাই বলি তাহলে সেখানে দেখা যায় যে সবাই শাশ্বতের অভিনয়ে এতটাই প্রভাবিত সেখানে অভিষেককে কেউ দেখতেই পারছেন না। সবাই শাশ্বতকেই খুজছেন। তাহলে আমি যদি একজনের জায়গায় যদি আরেকজনকে কল্পনা করে বসে থাকি তাহলে সেই মানুষটির কাজ আলাদাভাবে দেখব কি করে? অভিষেকের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। অভিষেক যেখানে ববকে নিজের মত করে একটি নতুন মাত্রা দান করেছেন সেখানে আবেগী দর্শক শাশ্বতের মাথা বসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। সত্যি কথা বলতে আমিও যে শাশ্বতকে মিস করিনি তা নয়, শাশ্বত যে অভিনয় করেছেন সেটা ভোলা দুঃসাধ্য। কিন্তু যখনই আমি অভিষেককে সেই জায়গায় দেখি তখন এক নতুন বব বিশ্বাসকে দেখা যায়। মানে বব বিশ্বাসকে নতুন কিন্তু আরেকটি ইতিবাচক গঠনে দেখা যাবে সেটি আমি খুব বেশী আশা করিনি। সবচেয়ে বড় বিষয় অভিষেক নিজের পুরো গতানুগতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে পরিবর্তন এনেছেন যা একটি নতুন চমক ছিল। মানমার্জিয়া, ব্রেথঃ ইনটু দ্যা শ্যাডোজ, বিগ বুল ইত্যাদি সিনেমা এবং সিরিজে কাজ করার পরও অভিষেককে নিয়ে এত সমালোচনার একটাই কারণ এইসব চরিত্রে এর আগে আরেকজন কাজ করেছেন যেগুলো খুবই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। যার কারণে দর্শকের চোখে নতুন মুখ দেখার বাসনাটা খুব একটা না থাকায় সেখানে অভিষেক বচ্চন ভাল কাজ করার পরও বার বার হচ্ছেন সমালোচিত।

এরপরে যদি আসি গল্পে তাহলে হ্যা একটি কথা বলতেই হবে গল্পটা কাহানির মত অত রহস্যপূর্ণ ছিল না! কাহানি যেখানে পুরোপুরি থ্রীলার সিনেমা সেখানে বব বিশ্বাস মোটাদাগে একটি ডার্ক কমেডি। ডিরেক্টর হিসেবে সুজয় ঘোষকে আশা করেছিলাম কিন্তু সেখানে আসেন তারই কন্যা দিয়া অন্নপূর্ণা ঘোষ। প্রথম সিনেমা হিসেবে দিয়া খুবই ভাল করেছেন, গল্পকে নিয়ে তিনি বারবার এমন কিছু মুহুর্ত তৈরী করেছেন যেগুলো একই সাথে হাস্যরসাত্মক এবং আকর্ষক ছিল। কিন্তু যে জায়গায় তিনি গড়বড় করেছেন সেটি হল বব বিশ্বাসের ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট। যে ব্যক্তি ৮ বছর কোমায় ছিল সে ব্যক্তি উঠেই সাথে সাথে কাজে নেমে পড়বে এটা একটু হলেও আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। কিন্তু সেটা হয়তোবা গল্পের গতিশীলতাকে বজায় রাখবার জন্যই করা হয়েছে কি না কে জানে! পরিচালক দিয়াই এটি ভাল বলতে পারবেন। লোকেশনের কথা যদি বলতে হয়ে তাহলে আমি বলবো এ ছিল যেন এক নতুন কোলকাতা! আমার কাছে মনে হয় কোলকাতাকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছিল পিকু সিনেমাতে। সুজিত সরকার খুব সুন্দর করে তুলেছেন কোলকাতাকে। কিন্তু বব বিশ্বাস আপনাকে একটু ভাবাতে বাধ্য করবে যে কোলকাতা মানেই শুধু হাওড়া ব্রীজ নয়, বা টানা রিকশার চলাচল নয়। কোলকাতাতে এছাড়া আরও অনেক কিছু আছে। সেই আরও জানতে ও বুঝতে চাইলে দেখে ফেলতে হবে বব বিশ্বাস সিনেমাটি। কিন্তু একটাই অনুরোধ দয়া করে শাশ্বত চ্যাটার্জীকে কল্পনা করে দেখতে বসবেন না। যেখানে অভিষেক এত সুন্দর চরিত্রায়ণ করেছেন সেখানে অন্য মানুষকে কল্পনা করার কোন মানে আছে কি?


লিখেছেনঃ এসবি মেরাজ

No comments

Powered by Blogger.